সংস্কারের অভাবে নষ্ট হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী ‘আতিয়া জামে মসজিদ’

যথাযথ যত্ন ও সংস্কারের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে জেলার চার শতাধিক বছরের ঐতিহ্যবাহী ‘আতিয়া জামে মসজিদ’।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
আতিয়া জামে মসজিদ
আতিয়া জামে মসজিদ | ইন্টারনেট

যথাযথ যত্ন ও সংস্কারের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে জেলার চার শতাধিক বছরের ঐতিহ্যবাহী ‘আতিয়া জামে মসজিদ’। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের আওতাধীন সম্পদ হওয়ায় এর সংস্কারের দায়িত্বও অধিদফতরের।

সরেজমিনে দেখা যায়, মসজিদের বাইরের দেয়ালের কারুকাজ খসে পড়ছে। ভেতরে ধসে পড়ছে দেয়াল। চুন, বালি ও সুরকির পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে।

টাঙ্গাইল জেলার ইতিহাস পাঠ থেকে জানা যায়, তৎকালীন আতিয়া পরগনার শাসনকর্তা সাঈদ খান পন্নী ১৬০৮ সালে মসজিদটি নির্মাণ করেন। সে সময় প্রখ্যাত স্থপতি মুহাম্মদ খাঁ এই মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা ও নির্মাণ কাজে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এরপর রওশন খাতুন চৌধুরাণী ১৮৩৭ সালে এবং আবুল আহমেদ খান গজনবী ১৯০৯ সালে মসজিদটির সংস্কার করেন। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকার মসজিদটিকে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে অধিগ্রহণ করে।

টাঙ্গাইল জেলায় যেসমস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন রয়েছে, এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আতিয়া জামে মসজিদ। টাঙ্গাইল সদর থেকে ছয় কিলোমিটার দক্ষিণে দেলদুয়ার উপজেলার আতিয়া গ্রামে মসজিদটি অবস্থিত। বাংলাদেশের পুরোনো ১০ টাকার নোটে রয়েছে আতিয়া জামে মসজিদের ছবি। একারণে আতিয়া জামে মসজিদ সবার কাছেই মোটামুটি পরিচিত।

মসজিদের নামকরণ ও নির্মাণের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, আরবি ‘আতা’ থেকে ‘আতিয়া’ শব্দটির উৎপত্তি, যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল ‘দান কৃত’। আলি শাহান শাহ্ বাবা আদম কাশ্মিরীকে (র.) সুলতান আলাউদ্দিন হুসাইন শাহ টাঙ্গাইল জেলার জায়গিরদার নিয়োগ করলে তিনি এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন। সে সময় তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচারের এবং আনুষঙ্গিক ব্যয় নির্বাহের জন্য আফগান নিবাসী কররানী শাসক সোলাইমান কররানীর কাছ থেকে সংলগ্ন এলাকা দান বা ওয়াকফ্ হিসাবে লাভ করেন। এ এলাকাটি তাকে দান করায় অঞ্চলটির নাম হয়েছে ‘আতিয়া’।

পরবর্তীতে বাবা আদম কাশ্মিরীর পরামর্শক্রমে সাঈদ খান পন্নীকে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর উক্ত আতিয়া পরগণার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। এই সাঈদ খান পন্নীই ১৬০৮ সালে বাবা আদম কাশ্মিরীর কবরের কাছে আতিয়া মসজিদ নির্মাণ করেন।

প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আতিয়া মসজিদের নির্মাণশৈলীতে সুলতানি ও মোগল উভয় আমলের বৈশিষ্ট্যের সুস্পষ্ট নির্দশন রয়েছে। সুলতানি আমলের নিদর্শন হচ্ছে মিহরাব, কিবলা দক্ষিণ এশীয়দের জন্য পশ্চিমে। আর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মসজিদের খিলানসমূহ। আতিয়া মসজিদের খিলানগুলো চতুর্কেন্দ্রিক। এর মানে হলো মসজিদটিতে চারটি দিক (উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম) দিয়ে প্রার্থনা কক্ষে প্রবেশ করা যায়। কিবলা দেয়ালে তিনটি অলঙ্কিত মিহরাব রয়েছে। চুন, সুরকির গাঁথুনি দিয়ে নির্মিত মসজিদটির দেয়ালে রয়েছে টেরাকোটার কারুকাজ। বক্রাকার কার্নিশ, সুচালো খিলান ও গম্বুজ সবই সুলতানি আমলের নিদর্শন। আতিয়া মসজিদের পূর্ব ও উত্তর দিকের বাইরের দেয়ালে টেরাকোটার ওপর চমৎকার বৃত্তের মাঝে ফুলের নকশা করা, যা মোগল আমলের নিদর্শন।

মসজিদটির দৈর্ঘ্য ১৮.২৯ মিটার , প্রস্থ ১২.১৯ মিটার, দেয়ালের পুরুত্ব ২.২৩ মিটার। মসজিদের চারকোনা অষ্টকোনাকৃতি মিনার রয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মসজিদ ইটের তৈরি। কারণ আমাদের এই দেশে পাথর সহজলভ্য না। পাথর দিয়ে তৈরি করতে চাইলে অন্য দেশ থেকে পাথর আমদানি করে আনতে হবে। প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। আদিতে মসজিদের ছোট তিনটি গম্বুজ পলকাটা বা ঢেউ তোলা ছিল। প্রধান গম্বুজটি ধসে পড়েছিল, সে জন্য পলকাটা বা ঢেউ তোলা বৈশিষ্ট্যটি বর্তমানে বিলুপ্ত।

মসজিদটিতে একটি আরবি ও একটি ফারসি ভাষার শিলালিপি পাওয়া যায়। এই লিপিগুলো থেকে মসজিদ নির্মাণের সময় জানা যায়।

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হওয়ায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দর্শনার্থীরা দেখতে আসে ৪১৭ বছরের পুরোনো ঐতিহ্য আতিয়া জামে মসজিদ।

টাঙ্গাইলের আতিয়া জামে মসজিদটি দেশের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শন। তবে মসজিদের দেয়ালের ওপর যে চিত্র ফলক ছিল, তা বহুলাংশে নষ্ট হয়েছে। মসজিদটি কতটা কারুকার্যময় ছিল তা বোঝা যায় এর নির্মাণশৈলী ও চিত্রফলক দেখে। এটি বাংলাদেশের অন্যান্য মসজিদ থেকে একটু ভিন্ন। মসজিদের প্রায় লাগোয়া পশ্চিম দিকেই রয়েছে হিন্দু-বৌদ্ধ যুগের অতি প্রাচীন একটি পুকুর। এর উত্তর-দক্ষিণে মাঝারি আকারের মসজিদের পূর্বদিকে রয়েছে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ। আতিয়া জামে মসজিদকে কেন্দ্র করে প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার স্থানজুড়ে বহু প্রাচীন কীর্তি ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন রয়েছে। মোগল আমলে এটি ছিল প্রশাসনিক কেন্দ্র। প্রাচীন হিন্দু-বৌদ্ধ-সুলতানি আমল ও ইংরেজ আমলের প্রথম দিকেও এ স্থানের প্রাধান্য ছিল।

স্থানীয় অ্যাডভোকেট রুহুল আমিন জানান, সপ্তাহের অন্য দিনের তুলনায় শুক্রবার দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থী বেশি আসেন মসজিদটি দেখতে। এছাড়াও অনেক সময় বিদেশ থেকে পর্যটক আসে। মসজিদটি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে থাকায় এলাকাবাসীর পক্ষে সংস্কার করার উপায় নেই।

তিনি বলেন, কিছুদিন আগে মসজিদের কাজ করেছে কর্তৃপক্ষ। কাজগুলো মনমতো হয়নি। বাইরের কারুকাজগুলো অসমাপ্ত রেখে চলে গেছে। বাকি কাজ সমাপ্ত করতে বর্তমান সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।

ঢাকা থেকে ঘুরতে আসা সম্রাট খান বলেন, বাংলাদেশের পুরোনো ১০ টাকার নোটে দেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আতিয়া জামে মসজিদের ছবি দেখেছি। বর্তমান সরকার যেন পুনরায় আতিয়া জামে মসজিদের ছবি টাকার নোটে ছাপানোর ব্যবস্থা করে।

স্থানীয় বাসিন্দা লিয়াকত আলী বলেন, আমাদের এই মসজিদে দূরদূরান্ত এবং স্থানীয় লোকজন নামাজ আদায় করে থাকেন। অন্যান্য সময়ে নামাজ পড়তে কোনো সমস্যা হয় না। তবে শুক্রবারের জুমার নামাজের সময় অনেক মুসল্লি হওয়ায় মসজিদে স্থান সংকুলান হয় না। তাই তিনি মসজিদটি বর্ধিত করার দাবি জানান।

মসজিদের মোয়াজ্জিন রফিকুল ইসলাম বাসসকে বলেন, আমি প্রায় ৩২ বছর ধরে এই মসজিদের মোয়াজ্জিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। মসজিদে যাতায়াতের রাস্তা নেই। যাতায়াতের জন্য রাস্তা করা জরুরি। শুক্রবার জুমআ’র নামাজের সময় মসজিদে মুসল্লিদের সংকুলান হয় না। মুসল্লি সংকুলানের জন্য মসজিদটি বর্ধিত করার দাবি জানাচ্ছি।

টাঙ্গাঈলের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো: আব্দুল্যাহ আল মামুন বাসসকে বলেন, দীর্ঘদিন অযত্ন-অবহেলায় থাকার পরে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর ১৯৭৮ সালে আতিয়া মসজিদটির দেখভাল করার দায়িত্ব পায়। তাই সংস্কার কাজটি তাদের দায়িত্বে। বিষয়টি আমরা তাদের অবহিত করব। আর নতুন করে ১০ টাকার নোটে যেন আবার আতিয়া মসজিদের ছবি স্থান, পায় সেজন্য আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানাব।

সূত্র : বাসস