গাজায় যুদ্ধবিরতি চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে ট্রাম্প

নয়া দিগন্ত ডেস্ক
Printed Edition
  • হামাসের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনায় নেতানিয়াহু সরকারে অসন্তোষ
  • গাজায় দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা বৃদ্ধি
  • পশ্চিমতীরের পরিস্থিতি ‘গভীর উদ্বেগজনক’ : জাতিসঙ্ঘ
  • ট্রাম্পের বক্তব্যের জবাবে হামাসের হুঁশিয়ারি

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বৃহস্পতিবার হামাসের সাথে ওয়াশিংটনের সরাসরি আলোচনার পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। ইসরাইলি বন্দীদের মুক্তি নিশ্চিত করার জন্যই এ আলোচনা পরিচালিত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। ওভাল অফিসে একটি নির্বাহী আদেশে সই করার সময় ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, আমরা ইসরাইলকে এই আলোচনায় সহায়তা করছি, কারণ আমরা ইসরাইলি বন্দীদের কথা ভাবছি। আমরা হামাসের জন্য কিছুই করছি না। আমরা তাদের (হামাসকে) নগদ অর্থও দিচ্ছি না।

তিনি হামাসের সাথে আলোচনার পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেন, আপনাকে অবশ্যই আলোচনা করতে হবে। আলোচনা করা আর অর্থ দেয়ার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আমরা এই লোকদের (হামাসের হাতে বন্দী) বের করে আনতে চাই। সাম্প্রতিক মুক্তি পাওয়া আট বন্দীর সাথে গত বুধবার বৈঠক করেছেন ট্রাম্প। বৈঠকের কথা স্মরণ করে ট্রাম্প বলেন, বন্দী অবস্থায় তাদের সাথে কতটা খারাপ আচরণ করা হয়েছিল, সে সম্পর্কে তাদের গল্প তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। চ্যানেল ১৩-এর খবর অনুসারে, ট্রাম্প বারবার বন্দীদের জিজ্ঞাসা করছিলেন যে, ইসরাইলি জনগণ কি যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম পর্যায়ের পরে বন্দী চুক্তি (যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ) চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে? সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠরা ট্রাম্পের প্রশ্নে যুদ্ধবিরতি চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে মত দেন। এর পরদিন বৃহস্পতিবার ট্রাম্প জানান, বন্দীরা তাকে চুক্তিটি চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে। তিনি বলেন, আমাদের আরো ৫৯ জন (বন্দী) বাকি আছে; যার মধ্যে ২৪ জন বেঁচে আছেন। মুক্তিপ্রাপ্তরা বলেছেন যে, তারা খুবই খারাপ অবস্থায় আছেন...।

নেতানিয়াহু সরকারে অসন্তোষ : এ দিকে টাইমস অব ইসরাইলের এক খবরে বলা হয়েছে, মার্কিন-হামাস সরাসরি আলোচনায় খুশি নয় ইসরাইল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সরকারি কর্মকর্তা এমনটি জানিয়েছেন। জানা গেছে, ইসরাইল ইচ্ছে করে হামাসের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি আলোচনার তথ্য মিডিয়ায় ফাঁস করেছে। যদিও হোয়াইট হাউজ দাবি করেছে, তারা এ বিষয়ে ইসরাইলের সাথেও পরামর্শ করেছে। তবে ওই ইসরাইলি কর্মকর্তা ইঙ্গিত দিয়েছেন, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সবশেষ বুধবারের আলোচনার বিষয়ে অবগত ছিলেন না। তিনি বলেন, হামাসের সাথে মার্কিন আলোচনার বিষয়টি মিডিয়া ফাঁসের ঘটনার পরই জানতে পেরেছেন নেতানিয়াহু। ইসরাইলি মিডিয়া ইয়নেটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ট্রাম্পের জিম্মি দূত অ্যাডাম বোহেলারের সাথে হামাসের সবশেষ বৈঠকে একটি বৃহত্তর চুক্তি নিয়ে আলোচনা অন্তর্ভুক্ত ছিল, যাতে বাকি জিম্মিকে মুক্তি দেয়া যায় এবং যুদ্ধের অবসান ঘটানো যায়। ইয়নেট জানিয়েছে, যখন ইসরাইল এই বৈঠকের কথা জানতে পারে, তখন তারা সংবাদমাধ্যমে এ তথ্য ফাঁস করে প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করার চেষ্টা করে। সরকারি কর্মকর্তা টাইমস অব ইসরাইলকে ইঙ্গিত দিয়েছেন, বৈঠকের তথ্য ফাঁস হওয়ায় ইসরাইলের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে এবং হামাসের সাথে আলোচনা তখন থেকে বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।

পশ্চিমতীরের পরিস্থিতি ‘গভীর উদ্বেগজনক’ : জাতিসঙ্ঘ

ফিলিস্তিনের অধিকৃত পশ্চিমতীরের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসঙ্ঘ। আনাদোলু এজেন্সি জানায়, বৈশ্বিক এ সংস্থাটির মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক ফিলিস্তিনের অধিকৃত পশ্চিমতীরের অবনতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে সতর্ক করেছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিশেষ করে পশ্চিমতীরের উত্তরাঞ্চলে আমাদের মানবিক সহকর্মীরা সতর্ক করছেন যে পরিস্থিতি গভীরভাবে উদ্বেগজনক। অংশীদাররা আমাদের বলছেন, তারা ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর অব্যাহত অভিযানের কারণে বাস্তুচ্যুতি থেকে শুরু করে বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট পর্যন্ত ধ্বংস হতে দেখছেন।’

তিনি জানান, জাতিসঙ্ঘ আন্তর্জাতিক আইনকে সর্বদা সম্মান করতে ও বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে জোর দেয়। গাজা উপত্যকা সম্পর্কে ডুজারিক বলেন, জাতিসঙ্ঘ সতর্ক করে দিয়ে বলছে, সাহায্যের প্রবাহ অতিদ্রুত আবার শুরু না হলে সেখানে ‘ইতোমধ্যেই বিদ্যমান বিপর্যয়কর’ পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পশ্চিমতীরজুড়ে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। সেখানে ইসরাইলি সেনাবাহিনী ও অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের হামলায় কমপক্ষে ৯৩০ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং প্রায় সাত হাজার আহত হয়েছেন। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত জুলাই মাসে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরাইলের দীর্ঘস্থায়ী দখলকে অবৈধ ঘোষণা করে এবং পশ্চিমতীর ও পূর্ব জেরুসালেমের সব বসতি খালি করার আহ্বান জানায়।

গাজায় দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা বৃদ্ধি : ইসরাইলি সেনাবাহিনীর অবরোধের ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় ছয় দিন ধরে কোনো সহায়তা প্রবেশ করতে পারছে না। সহায়তা সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের জন্য নির্ধারিত কয়েক শ’ মিলিয়ন ডলার সহায়তা যুক্তরাষ্ট্র সরকার স্থগিত করেছে। গাজা যুদ্ধবিরতি সঙ্কটে পড়েছে এবং হামাসের সামরিক মুখপাত্র জানিয়েছেন, ‘প্রতিরোধ সর্বোচ্চ প্রস্তুতির অবস্থানে রয়েছে এবং সব পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত।’

মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর জানিয়েছে, মিসর ও আরব নেতাদের প্রস্তাবিত যুদ্ধ-পরবর্তী গাজা শাসনের পরিকল্পনাকে ট্রাম্প প্রশাসন ‘যথাযথ’ বলে মনে করছে না। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে যে, ইসরাইলের যুদ্ধবিমান হামলায় ৪৮ হাজার ৪৪০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে এবং এক লাখ ১১ হাজার ৮৪৫ জন আহত হয়েছে। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, সর্বশেষ নিহতের সংখ্যা কমপক্ষে ৬১ হাজার ৭০৯; কারণ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে থাকা হাজারো মানুষকেও মৃত বলে ধারণা করা হচ্ছে।

গাজায় ইসরাইলি ড্রোন হামলায় ফিলিস্তিনি নিহত : ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে ইসরাইলি বিমান হামলায় এক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এ হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন আরো একজন। তুরস্কের বার্তাসংস্থা আনাদোলু এজেন্সি (এএ) এ খবর জানিয়েছে। খবরে বলা হয়, বৃহস্পতিবার গাজা সিটিতে এ হামলার ঘটনাটি ঘটে। যুদ্ধবিরতি চুক্তি সত্ত্বেও ইসরাইল প্রায় প্রতিদিনই গাজায় হামলা চালাচ্ছে এবং এতে বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, শুজাইয়া পাড়ার পূর্ব অংশে তাদের বাড়িতে যাওয়ার সময় একটি ইসরাইলি ড্রোন বেসামরিক নাগরিকদের একটি দলকে লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে এবং এতেই ঘটে হতাহতের ঘটনা। গাজায় গত ১৯ জানুয়ারি থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও গাজার স্থানীয় কর্তৃপক্ষ প্রায় প্রতিদিনই ইসরাইলি সেনাবাহিনীর দ্বারা যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের খবর দিয়েছে।

ট্রাম্পের বক্তব্যের জবাবে হামাসের হুঁশিয়ারি : ফিলিস্তিনের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের সামরিক শাখা আল-কাসসাম ব্রিগেড জানিয়েছে, তারা ‘সব রকমের সম্ভাবনার’ জন্য প্রস্তুত এবং ‘উচ্চ সতর্কতা’ বজায় রেখেছে। সংগঠনটি জোর দিয়ে বলেছে, অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় দখলদার বাহিনী নতুন করে যুদ্ধ শুরু করলে ইসরাইলি বন্দীদের মুক্তির নিশ্চয়তা থাকবে না। আল-কাসসাম ব্রিগেডের মুখপাত্র আবু উবায়দা বৃহস্পতিবার এক ভিডিও বক্তৃতায় এ মন্তব্য করেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, দখলদার সরকার অস্ত্র ও যুদ্ধের মাধ্যমে যা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে তা কখনই হুমকি ও প্রতারণার মাধ্যমে অর্জন করা যাবে না।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুমকি দেয়ার ঠিক এক দিন পর আবু উবায়দা এ মন্তব্য করলেন। ট্রাম্প হুমকি দিয়ে বলেছেন, গাজা উপত্যকায় আটক অবশিষ্ট ইসরাইলি বন্দীদের অবিলম্বে মুক্তি না দিলে ফিলিস্তিনি এবং হামাস যোদ্ধাদের হত্যা করা হবে। আবু উবায়দা বলেন, ‘শত্রুদের যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন এবং বিশ্বাসঘাতকতা সত্ত্বেও আমরা বিশ্ব এবং মধ্যস্থতাকারীদের সামনে বন্দিবিনিময় চুক্তি মেনে চলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যেকোনো অজুহাত বাদ দিয়ে এবং প্রতিশ্রুতি রক্ষার মাধ্যমে আমাদের জনগণের রক্তপাত ঠেকাতে এবং চুক্তি বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।’

ইরানের সংবাদমাধ্যম পার্সটুডে জানায়, ১৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া তিন ধাপের গাজা যুদ্ধবিরতির আওতায় ইসরাইল হামাসের দীর্ঘস্থায়ী আলোচনার শর্ত মেনে নেয়। শনিবার শেষ হওয়া প্রথম ধাপে আটটি লাশসহ মোট ৩৩ জন ইসরাইলি বন্দীকে মুক্তি দেয়া হয়, যার বিনিময়ে ইসরাইলি কারাগারে আটক প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। তবে ইসরাইল যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপে এগিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে যুদ্ধের স্থায়ী অবসান, গাজা থেকে দখলদার সৈন্যদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার এবং সব বন্দীকে মুক্তি দেয়ার কথা বলা হয়েছে।