বৈষম্য দূরীকরণে জাকাতের ভূমিকা
Printed Edition
মো: মাঈন উদ্দীন
ইসলামী রাষ্ট্রে জাকাত তুলতে আলাদা কর্মচারী নিয়োগ দেয়ার বিধান রয়েছে। সংগৃহীত অর্থ দিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বেকার যুবক ও নারীদের কাজে নিয়োজিত করে তাদের স্বাবলম্বী করা যেতে পারে। জাকাত সম্পদ বাড়িয়ে দেয়। জাকাত দেয়ায় সম্পদ কোথাও জমা হয়ে থাকতে পারে না। অগণিত মানুষের হাতে পৌঁছে যায় জাকাতের অর্থ-সম্পদ। তারা তাদের চাহিদা পূরণে তা ব্যবহার করতে পারে। তারা প্রাপ্ত অর্থ-সম্পদকে বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ করতে পারে। বিনিয়োগের কারণে সম্পদ এক জায়গায় পুঞ্জীভূত হয়ে থাকে না; বরং এর মাধ্যমে সম্পদ বাড়ে। ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। এতে বাজারে চাহিদা বাড়লে উৎপাদনও বাড়ে। আর উৎপাদন বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়ে। ফলে সমাজ থেকে বেকারত্ব ও অভাব দূর হয়। এভাবে জাকাত ইসলামী সমাজে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করে
ইসলামী অর্থনীতিতে জাকাতব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, যা ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সম্পদের ভারসাম্য রক্ষা করে সমাজে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে। জাকাত শব্দের আভিধানিক অর্থ- পবিত্রতা ও প্রবৃদ্ধি। জাকাত দেয়ার মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র, আত্মা শুদ্ধ হয়। জাকাত দিলে সম্পদে বরকত হয়। জাকাত নিছক একটি দান নয়; বরং এটি একটি ফরজ ইবাদত। প্রত্যেক স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক মুসলিম নর-নারীকে প্রতি বছর স্বীয় আয় ও সম্পত্তির একটি নির্দিষ্ট অংশ, যদি তা ইসলামী শরিয়ত নির্ধারিত সীমা (নিসাব পরিমাণ) অতিক্রম করে তবে, গরিব-দুস্থদের মধ্যে বিতরণের নিয়মকে জাকাত বলা হয়। মুসলিম অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিতে জাকাত অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের একটি কার্যকর হাতিয়ার। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন- ‘এবং তাদের ধন সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতের হক।’ (সূরা আজ-জারিয়াত-১৯) এর মাধ্যমে আল্লাহ ধনীদের সম্পদে দরিদ্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছেন। এ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ধনীদের থেকে সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করা হয়, ফলে সম্পদের কেন্দ্রীকরণ হ্রাস পায়। অর্থনৈতিক ভারসাম্য তৈরি হয়। মুসলিম ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে সেদিন থেকে এক চান্দ্রবর্ষ (৩৫৪-৩৫৫ দিন) পূর্ণ হলে তাকে জাকাত দিতে হয়। জাকাতের নিসাব হলো- সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা অথবা এর কোনো একটির সমমূল্যের নগদ টাকা বা ব্যবসার পণ্য। নিসাব পরিমাণ ও তদূর্ধ্ব সম্পদের মালিক তার জাকাতযোগ্য সব সম্পদের জাকাত প্রতি বছর ২ দশমিক ৫ শতাংশ (৪০ ভাগের ১ ভাগ) হারে দিতে হয়। জমি, বাড়ি ও গাড়ি যা বিক্রয়ের জন্য রাখা হয়নি, তা জাকাত হিসাবের অন্তর্ভুক্ত হবে না। জাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে তাৎক্ষণিক পরিশোধযোগ্য ঋণ। কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য ঋণের চলমান কিস্তির পরিমাণ অর্থ বাদ রেখে অবশিষ্ট সম্পদের জাকাত দিতে হবে। জাকাতের অর্থ যাদের দেয়া যাবে তা পবিত্র কুরআনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- ফকির, মিসকিন, জাকাত উসুল ও আদায়ের কাজে নিয়োজিত, ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করতে, দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, জেহাদকারীর জন্য এবং মুসাফিরকে জাকাতের অর্থ দেয়া যাবে। জাকাত দেয়ার ক্ষেত্রে আত্মীয়-স্বজনকে প্রাধান্য দেয়া উচিত। জাকাত আদায়ের সময় ‘জাকাতের টাকা’ উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। আদায়ের সময় বা জাকাতের টাকা আলাদা করার সময় নিয়ত করলে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, জাকাতের ক্ষেত্রে গরিবকে মালিক বানিয়ে দেয়া শর্ত। গরিবকে জাকাতের টাকার মালিক বানিয়ে দিতে হবে। কোনো গরিবকে পড়াশোনা, চিকিৎসা, বিয়ে দিতেও জাকাত দেয়া যেতে পারে। তবে তাকে সে টাকার মালিক বানিয়ে দিতে হবে। জাকাতে দারিদ্র্য কমে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হয়। প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ইবনে খালদুন তার ‘আল মুকাদ্দিমা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, জাকাত একটি কার্যকর সামাজিক ন্যায়বিচার ব্যবস্থা, যা অর্থনীতিতে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে। জাকাত উৎপাদনশীলতা বাড়ায়। জাকাতব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হয়। সমসাময়িক অর্থনীতিবিদরাও মনে করেন, জাকাতের সঠিক বাস্তবায়ন হলে সমাজে বেকারত্ব কমবে। নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নত হবে। অন্যদিকে, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পুঁজিবাদ ধনীদের আরো ধনী করে। গরিবদের আরো বঞ্চিত করে। কিন্তু ইসলামিক অর্থনীতিতে জাকাত ধনীদের থেকে সম্পদ সংগ্রহ করে দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করে, অর্থনীতিতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা নিশ্চিত হয়। ইসলামী অর্থনীতিতে জাকাতকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়েছে। রাষ্ট্র এমন একটি কাঠামো তৈরি করবে যার মাধ্যমে জাকাত প্রদানের উপযুক্ত ব্যক্তিরা নির্দিষ্ট সময় শেষে যাকাত ফান্ডে অর্থ জমা করবেন। এ জমা করা অর্থ কুরআনে বর্ণিত আট শ্রেণীর লোকদের কাছে উপযুক্ত পরিবেশ ও পরিকল্পনা নিয়ে বিতরণ করতে হবে। জাকাত শুধু দারিদ্র্যবিমোচনের হাতিয়ার নয়; বরং এটি সামাজিক ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ শক্তিশালী করে। তাই বলা যায়, জাকাত একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, যা দারিদ্র্য, বঞ্চনা ও বৈষম্য দূর করে একটি সমৃদ্ধ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়তে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বেকারত্ব দূর করতে জাকাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। জাকাতের অর্থ দিয়ে নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করা যায়। জাকাতের অর্থ গ্রহণের পর উপযুক্ত ব্যক্তির মধ্যে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা মাধ্যমে নানা ধরনের মিল-কলকারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেতে পারে। অথবা বেকাররা স্বাবলম্বী হতে পারে- এ পরিমাণ জাকাতের অর্থ দেয়ারও সুযোগ রয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রে জাকাত তুলতে আলাদা কর্মচারী নিয়োগ দেয়ার বিধান রয়েছে। সংগৃহীত অর্থ দিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বেকার যুবক ও নারীদের কাজে নিয়োজিত করে তাদের স্বাবলম্বী করা যেতে পারে। জাকাত সম্পদ বাড়িয়ে দেয়। জাকাত দেয়ায় সম্পদ কোথাও জমা হয়ে থাকতে পারে না। অগণিত মানুষের হাতে পৌঁছে যায় জাকাতের অর্থ-সম্পদ। তারা তাদের চাহিদা পূরণে তা ব্যবহার করতে পারে। তারা প্রাপ্ত অর্থ-সম্পদকে বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ করতে পারে। বিনিয়োগের কারণে সম্পদ এক জায়গায় পুঞ্জীভূত হয়ে থাকে না; বরং এর মাধ্যমে সম্পদ বাড়ে। ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। এতে বাজারে চাহিদা বাড়লে উৎপাদনও বাড়ে। আর উৎপাদন বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়ে। ফলে সমাজ থেকে বেকারত্ব ও অভাব দূর হয়। এভাবে জাকাত ইসলামী সমাজে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করে। আমাদের সমাজের প্রতিটি খাতে দুর্নীতি ও বৈষম্য বিরাজমান। এসব বৈষম্যের মূলোৎপাটন করতে হলে জাকাত-ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জাকাত-ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও তার সঠিক প্রয়োগই পারে সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে সুষম ও ভারসাম্যপূর্ণ দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ করতে।
লেখক : ব্যাংকার ও অর্থনীতির বিশ্লেষক
ইমেইল : [email protected]