ভিএনআর-২০২৫ আলোচনায় ড. দেবপ্রিয়
ব্যবসায়ী নেতারা দুর্নীতিতে থেকেও টেকসই উন্নয়নের কথা বলেছেন
Printed Edition
বিশেষ সংবাদদাতা
অতীতে দেশের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে যারা ছিলেন তারা একই সাথে দুর্নীতি করেছেন, আবার টেকসই উন্নয়নের কথাও বলেছেন। এটা অনেকটা ফাঁকা বুলির মতো বলে মন্তব্য করেছেন এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, নতুন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা একটি টেকসই অর্থনীতি গড়ে তোলার মধ্যে নিহিত রয়েছে। আর টেকসই অর্থনীতির জন্য প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতি ও রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে হবে।
শেরেবাংলা নগররে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে গতকাল এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ আয়োজিত ‘জাতীয় এসডিজি রিপোর্ট (ভিএনআর) ২০২৫ ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের ভাবনা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য রাখেন এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশের নেটওয়ার্ক ফোকাল পয়েন্ট তারাননুম জিনান।
এছাড়া অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, যথাযথ ব্র্যান্ডিংয়ের অভাবে আমরা দায়িত্বশীল উৎপাদনের বাণিজ্যিক সুবিধা তথা প্রকৃত বাজারমূল্য ধরতে পারছি না। শ্রমবাজারে আসা শ্রমশক্তিকে কর্মসংস্থান দিতে না পারার কারণে তারা বিদেশে চলে যাচ্ছে অদক্ষ হয়ে। সেখানে তারা কম মূল্যে শ্রম দিচ্ছে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমাদের দেশে আগের চেয়ে অনেক বেশি টেকসই উন্নয়নের ধারণার প্রসার ঘটেছে এবং গভীরতাও বেড়েছে। এ অর্জনটি আমাদের বেসরকারি খাতের অর্জন। এ অর্জন সবসময় সঠিকভাবে মূল্যায়িত হয় না, এটিও ঠিক। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সাসটেইনেবলিটির প্রসার ও এর অর্জনের যথেষ্ট স্বীকৃতি নেই। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা এটিকে বিশ্বের কাছে এবং সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে তুলে ধরতে পারিনি।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, আবার বেসরকারি খাতের জন্য উপযুক্ত ব্যবসার পরিবেশ না থাকলে টেকসই ব্যবসা মডেলও তৈরি হবে না। সাসটেইনেবল মডেলকে আরো প্রসার করতে হলে বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিবেশকে আরো উন্নত করতে হবে এবং সরকারের পক্ষ থেকেও সমর্থন বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে অর্থায়ন সমস্যা, জ্বালানি, সরবরাহ, নিয়ন্ত্রণমূলক হয়রানি ব্যবস্থা ও শ্রম পরিস্থিতির মতো বিষয়গুলো সমাধান করা প্রয়োজন।
অতীতের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বিগত সময়ে যতগুলো চেম্বার অব কমার্স ছিল তারা তাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেনি। তখন দেশের ভেতরে নির্বাচন হয়নি, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও নির্বাচন হয়নি। আর যেখানে নির্বাচন নেই, প্রতিযোগিতা নেই, সেখানে আমরা টেকসই উন্নয়ন করব- এটা তো হবে না।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি কামরান টি রহমান বলেছেন, প্রতি বছর দেশের লেবার মার্কেটে ২০ থেকে ২৫ লাখ মানুষ যুক্ত হচ্ছে। যাদের আমরা কর্মসংস্থানের সুযোগ দিতে পারছি না। ফলে তারা ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্টে যাচ্ছে। তাদের বেশির ভাগই অদক্ষ। ফলে অন্য দেশের শ্রমিকদের তুলনায় তাদের বেতন তুলনামূলক কম হয়। তাই আমাদের শিক্ষা কারিকুলাম পুনর্বিবেচনা করা উচিত। তিনি বলেন, বিবিএস লেবার ফোর্স সার্ভে ২০২৩ অনুযায়ী বাংলাদেশের লেবার মার্কেটে সাড়ে ছয় থেকে সাত কোটি মানুষ কাজ করে। এর মধ্যে মাত্র ১ দশমিক ২৫ কোটি ফরমাল সেক্টরে কাজ করে, যা মোট সংখ্যার মাত্র ১৫ শতাংশ।
সিটিজেনস প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ মেম্বার ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকারি-বেসরকারি উভয় জায়গা থেকেই কাজ করতে হবে। বিশেষ করে এক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতের বড় ভূমিকা রয়েছে। বলা যায়, ব্যক্তি খাতের উন্নয়ন ছাড়া এসডিজি অর্জন সম্ভব নয়।
নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি মো: ফজলুল হক বলেন, দেশের প্রায় সবগুলো তৈরী পোশাক প্রতিষ্ঠান সুরক্ষা ও নিরাপত্তার দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে। শুধু প্রাকৃতিক পরিবেশ নয়, নিরাপদ কর্মপরিবেশও নিশ্চিত করা হচ্ছে কারখানাগুলোতে। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে এটার তেমন স্বীকৃতি নেই। এটি আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
ফজলুল হক বলেন, আমাদের এখনো রানা প্লাজা ও তাজরীন ফ্যাশনের কথা শুনতে হয়। অথচ দেশে আড়াইশর বেশি সনদপ্রাপ্ত পরিবেশবান্ধব কারখানা রয়েছে। বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরতে সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের প্রয়োজন।
জাতিসঙ্ঘ গ্লোবাল কমপ্যাক্ট নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক শাহামিন জামান বলেন, আমরা দেখেছি প্রধানমন্ত্রীর তহবিলসহ বিভিন্ন খাতে সিএসআরের অর্থ ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু এসডিজি বাস্তবায়নে এসব অর্থ কতটা কার্যকরভাবে ব্যবহার হচ্ছে, তা বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে। এসডিজি বাস্তবায়নে বেসরকারি খাতের অবদানকে অবশ্যই আমলে নিতে হবে।
নিউ এইজ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ভাইস চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহীম বলেন, তিনভাবে ব্যক্তি খাত এসডিজি অর্থায়নে যুক্ত হতে পারে। সিএসআর থেকে অর্থায়ন, সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ এবং গ্রিন বন্ডের মতো টেকসই অর্থায়নের ব্যবস্থা করা।
ইউএনডিপি বাংলাদেশের সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি আনোয়ারুল হক বলেন, উন্নয়ন বাজেট দিয়ে এসডিজি পূরণ হবে না, এখানে সবার অংশগ্রহণ লাগবে। আমাদের দেশে সামাজিক ব্যবসার জন্য এখনো আইনি কাঠামো তৈরি হয়নি। আর্থিক সুযোগ, দায়িত্বপূর্ণ উৎপাদন, শোভন কাজ নিয়ে অনেক কাজ করতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মহাপরিচালক (এসডিজি-বিষয়ক) শিহাব কাদের বলেন, তরুণদের একটা শক্তি আছে, যা দ্বারা তারা পরিবর্তন আনতে পারে। তাদের মাধ্যমেই আগামী দিনের বাংলাদেশ পরিচালিত হবে।
ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের করপোরেট অ্যাফেয়ার্স, পার্টনারশিপ এবং কমিউনিকেশন পরিচালক শামীমা আক্তার বলেন, বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগের গন্তব্য বানাতে হলে টেকসই ব্যবস্থার বিকল্প নেই। কোনো বহুজাতিক কোম্পানি যদি এখানে আসে, তারা অবশ্যই দেখতে চায় যে এখানে ব্যবসা করার টেকসই ব্যবস্থা আছে কি না।