রমজানে কিছু টিপস
Printed Edition
তৌফিক আল মোবারক
(গত দিনের পর)
হাল্কা বিশ্রাম বা পাওয়ার ন্যাপ নিয়েও নিজেকে সতেজ ও সক্রিয় করে তুলতে পারেন। রমজান মাসে আমরা ‘লাঞ্চ-আওয়ার’ বা মধ্যাহ্নভোজের বিরতিকে হাল্কা বিশ্রাম বা পাওয়ার ন্যাপের জন্য কাজে লাগাতে পারি। ১৫ থেকে ২০ মিনিটের পাওয়ার ন্যাপে রয়েছে নতুন প্রাণশক্তি জোগানোর ক্ষমতা। পাওয়ার ন্যাপের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে তা যেন ২০ মিনিটের ঊর্ধ্বে না হয়। প্রয়োজনে অ্যালার্ম দিয়ে রাখতে পারেন, যাতে ২০ মিনিটেই উঠে পড়েন।
দিনের নানাবিধ ব্যস্ততার মধ্যেও আমরা চাইলে কিছুটা সময় আলাদা করে হাল্কা কিছু ইবাদতের জন্য কাজে লাগাতে পারি। যে সময়টি আমরা টি ব্রেক, বা চা-নাশতার জন্য ব্যয় করতাম, সেই সময়টাই যদি হাল্কা কিছু ইবাদত, যেমন অজু করে দুই রাকাত দোহার নামাজ পড়ি, কিংবা ১০-১৫ মিনিট কুরআন পাঠ বা অধ্যয়ন করি তাতে একদিকে যেমন আমাদের দেহ-মনের রিফ্রেশমেন্টের একটি ব্যবস্থা হয়, পাশাপাশি ব্যস্ত কাজের ফাঁকেও কিছু ইবাদতের সুযোগ তৈরি হয়ে যায়। এর জন্য রমজানের আগ থেকেই যদি সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে, প্ল্যানিং করে রাখা যায়, তাহলে খুব সহজেই এই ছোট ছোট ইবাদতগুলো নিজের কাজের মধ্যেই মানিয়ে নেয়া সহজ হয়ে যায়।
একটানা কাজ না করে অল্প কিছুক্ষণ পরে হাল্কা ব্যায়াম করলে শরীরের উপর চাপটা কম পড়ে। এতে শরীরে জড়তা তৈরি হয় না, তাই সারা দিন কাজ করলেও তেমন একটি কষ্ট অনুভূত হয় না। বিশেষ করে যারা বসে বসে কাজ করেন (যেমন- ডেস্ক কেন্দ্রিক কাজ), তাদের জন্য হাল্কা নড়াচড়া বা ব্যায়াম করার ব্যাপারে ডাক্তাররাও পরামর্শ দিয়ে থাকেন। রমজানেও ৩০-৪০ মিনিট কাজ করে হাল্কা ব্যায়াম করার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন।
সারা মাস অনেক কাজ থাকে, তাই আমাদের অনেকেরই আলাদা করে ইতেকাফে বসার সুযোগ হয়ে উঠে না। কিন্তু আমরা চাইলেই আমাদের বার্ষিক ছুটি থেকেই কিছু দিন ছুটি নিয়ে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইতেকাফে বসতে পারি। পুরো ১০ দিন ছুটি নেয়ার সুযোগ না থাকলে কেবল বেজোড় রাতের পরবর্তী দিনগুলোও ছুটি নিতে পারি, যাতে রাত জেগে কিয়ামুল লাইল করা যায়। তাতে মাঝখানে সাপ্তাহিক ছুটির দিন পড়লে পুরো পাঁচটি দিন ছুটি নিতে হচ্ছে না, কেবল দু-এক দিন ছুটি নিলেই হচ্ছে। এ ছাড়াও সরকারি ছুটি পড়ে গেলে তো বোনাস হিসেবে পেয়ে যাচ্ছেন! এভাবে আমরা কিয়ামুল লাইল ও ইতেকাফের জন্যও পরিকল্পনা করে ফেলতে পারি খুব সহজেই।
রমজানে পাঠ পরিকল্পনা : রমজান মাস যেমন কুরআন নাজিলের মাস, তেমনি আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির মাস। এই মাসেই দ্বীনের অনেক বিষয় সম্পর্কে আমাদের জানার ও মানার সুযোগ হয়ে উঠে। আমাদের সুষ্ঠু পরিকল্পনা থাকলে সেই জানার সুযোগটিকে আরো ফলপ্রসূ করে তোলা সম্ভব হবে। যেমন-
আমাদের প্রত্যেকেরই কুরআনকেন্দ্রিক একটি পরিকল্পনা থাকা উচিত। আমাদের যারা কুরআন মাজিদ পড়তে কম পারি, তারা কুরআন শিক্ষার ব্যাপারে একটি পরিকল্পনা রাখতে পারি। আর যারা কুরআন তেলাওয়াতে সাবলীল, আমরা কুরআন খতম করার পরিকল্পনা রাখতে পারি। কিংবা কিছু সূরা মুখস্থ করার পরিকল্পনা করতে পারি। কেবল তেলাওয়াতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে, আমরা সবাই কুরআন মাজিদের কোনো একটি তাফসির নিয়ে কুরআন অধ্যয়নের পরিকল্পনা রাখতে পারি। ছোট হোক আর বড় হোক, একটি সূরা হোক বা অল্প কয়েকটি হোক, বাংলা ভাষায় হোক আর ইংরেজি, আরবিতে হোক, যেকোনো একটি তাফসির অধ্যয়ন আমাদের পরিকল্পনায় রাখা উচিত। এতে কুরআন নাজিলের মাসে কুরআন শরিফের সাথে আরো সুদৃঢ় সম্পর্ক বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে, ইনশাআল্লাহ। যারা প্রথমবারের মতোই শুরু করতে আগ্রহী, শেষ পারার প্রায় সময় পঠিত সূরাগুলোর তাফসির দিয়েই শুরু করতে পারি। এতে নিয়মিত নামাজে আমরা কি পড়ছি, সে সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা জন্মাবে এবং নামাজেও মনোযোগ বৃদ্ধি পাবে, ইনশাআল্লাহ।
কুরআন তেলাওয়াতের পাশাপাশি হাদিসকেন্দ্রিক একটি পরিকল্পনাও থাকা উচিত। কেউ হয়তো সহিহ বুখারির কেবল কিতাবুস-সাউম (রোজা অধ্যায়) অধ্যয়নের জন্য পরিকল্পনা করতে পারেন। কেউ হয়তো সহিহ মুসলিম থেকে নির্বাচন করতে পারেন, বা অন্য যেকোনো একটি হাদিস গ্রন্থের যেকোনো অধ্যায়ও হতে পারে। কেউ হয়তো মাত্র ৩০টি হাদিস নির্ধারণ করে নিতে পারেন, যাতে দিনে একটি করে পড়তে পারেন। যার যার সুবিধামতো পুরো মাসের একটি হাদিস অধ্যয়নের পরিকল্পনা রাখা উচিত।
কুরআন-হাদিসের পাশাপাশি আমাদের পাঠ পরিকল্পনায় সিরাহ (রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনী ও ইতিহাস), ফিকহ (ইসলামী বিধিবিধান) বা ইসলাম সম্পর্কিত যেকোনো বিষয়ই থাকতে পারে। প্রিয় নবী সা:-এর জীবনী সম্পর্কে আমাদের সবারই জানা উচিত। তাঁর সাহাবিরা কিভাবে তাঁকে ভালো বেসেছেন, অনুসরণ করেছেন, কিভাবে তাঁরা মাত্র দুই দশকের ব্যবধানে বর্বরতার অন্ধকার চিরে পৃথিবীর বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হলেন, তা কি জানতে আমাদের মোটেও আগ্রহ জন্মে না? পাশাপাশি, আমরা প্রতিনিয়ত যেসব ইবাদত করছি, নামাজ-রোজার মতোই অন্যান্য ইবাদতের ব্যাপারেও আমাদের সঠিক বিধি-বিধানগুলো জেনে রাখা উচিত এবং রমজান মাসই হতে পারে এই জ্ঞানান্বেষণের প্রথম উদ্যোগ। ব্যক্তিগতভাবে যদি এ ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে ইসলামের বিষয় সম্পর্কে জেনে নেয়া কঠিন মনে হয়, সে ক্ষেত্রে পারিবারিকভাবে কিংবা এলাকার মসজিদভিত্তিক অনুরূপ পরিকল্পনা নেয়া যেতে পারে। ইমামকে বলে, হয়তো ইশার নামাজের পরে কিংবা ফজরের নামাজের পরে মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য সবাই মিলে সিরাহ বা ফিকহ থেকে একটি ছোট আলোচনা শুনার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। আর যদি এই চর্চাটি বাসায় করতে চান, তাতে পারিবারিক সৌহার্দ্য বৃদ্ধিরও এক অপরূপ দৃষ্টান্ত তৈরি হবে।
রমজানে ব্যক্তিগত মান বৃদ্ধি : আমরা প্রত্যেকেই মৃত্যুর পরে জান্নাত আশা করি। আমরা কেউই চাইনা দোজখের আগুনে একটি মুহূর্তও জ্বলতে। কিন্তু ‘মানুষ’ হিসেবেই আমাদের অনেক দুর্বলতা রয়েছে এবং প্রতিনিয়তই ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক, অনেক ভুলত্রুটির মুখোমুখি হই। প্রতি বছরই রমজান মাস আমাদের কাছে এসে কড়া নেড়ে জানতে চায়, কে আছে আমাদের মাঝে যে সারা বছর আরো ভালো মুসলমান হয়ে থাকতে ইচ্ছুক? কে আছে আল্লাহর আরো কাছে যেতে ইচ্ছুক? কে আছে, দ্বীনকে আরো ভালোভাবে বুঝতে ইচ্ছুক? রমজান আমাদের জন্য সেই সুযোগটিই নিয়ে আসে, যাতে আমরা এই মাসের শৃঙ্খলিত নিয়মে আবিষ্ট হয়ে সারা বছর যেন আরো ভালো মানুষ হয়ে থাকতে পারি। এর জন্য আমাদের যেমন সচেতনতার প্রয়োজন, তেমনি সঠিক পরিকল্পনারও প্রয়োজন।
রমজানে ইবাদত-বন্দেগি : রমজান মাসটাই ইবাদতের মাস। অন্যান্য কাজের মতোই আমাদের ইবাদতের জন্য একটি সুস্পষ্ট প্ল্যানিং থাকা উচিত। প্ল্যানিং করার মাধ্যমেই আপনি কখন কি ইবাদত করবেন এবং কিভাবে করবেন, তা আপনার কাছে আগে থেকেই পরিচ্ছন্ন ধারণা থাকবে। ইবাদতের প্ল্যানিংয়ে থাকতে হবে জিকর ও দোয়াগুলো সঠিকভাবে করা। সকাল ও বিকেলের জিকির যেন আপনার মিস না হয়, তার জন্য আপনার প্রিয় কোনো অ্যাপস বা বই সাথে রাখতে পারেন। সময়মতোই বসে সেরে ফেলতে পারেন সব জিকির।
দোয়ার একটি লিস্ট করে ফেলুন। রমজান মাস দোয়া কবুলের মাস। কেননা রমজানবিষয়ক যেসব আয়াত আমরা সূরা বাকারায় পড়ি, তার ঠিক মাঝখানের আয়াতটিই দোয়া সম্পর্কিত। (সূরা আল-বাকারা-১৮৬) শুধু তাই নয়, ‘আল্লাহ পাক এই আয়াতে নিজেই তাঁর বান্দার দোয়া কবুল করেন, এই কথাটি খুব জোর দিয়ে প্রকাশ করেছেন। (চলবে)