ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন দিন
Printed Edition
সাদেক রহমান
অনেক বিরোধিতার মুখেও দলীয় প্রতীক দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন করে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল বিগত ফ্যাসিবাদী সরকার। সাধারণত তৃণমূল নেতাকর্মীরাই সেবামূলক কর্মকাণ্ডের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকে। সেই বিবেচনায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে গোড়া থেকেই পরোক্ষ রাজনৈতিক প্রভাব থাকলেও কখনোই সরাসরি দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন হয়নি। কিন্তু ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার কোনো বিচার-বিবেচনার তোয়াক্কা না করেই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করে গ্রামের সহজ সরল মানুষের মধ্যে যে পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক সম্প্রীতি ছিল তা হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিল। দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের নেতিবাচক প্রভাবও দেশের মানুষের মধ্যে ভয়ঙ্করভাবে পড়েছিল। তৃণমূল নেতাকর্মীরা জনগণের সেবা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে দলীয় লেজুড়বৃত্তির দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। তৃণমূল নেতাকর্মীরা কেউ এখন জনসেবা করে মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করে না। কিভাবে খুব সহজেই দলীয় মনোনয়ন পাবে- সেই চেষ্টা-তদবিরে ব্যস্ত থাকে। ফলে তৃণমূলে জনগণের ভোগান্তির সীমা অতিক্রম করল। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার নির্বিচার অন্যায়-অবিচার, লুটপাট, দুর্নীতি, গুম, খুনের মাধ্যমে দেশকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সাত মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ এক নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছাত্ররা সরাসরি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করে জাতীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে যা ইতোমধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ছাত্রদের টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনার জন্য যে অর্থনৈতিক সামর্থ্য দরকার তা তারা কিভাবে অর্জন করল। নেপথ্যে কারা তাদেরকে অর্থসহায়তা দিচ্ছে। ছাত্ররা সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনার দাবি করে নিজেরাই ক্ষমতার অপব্যবহার করছে কি না বা ছাত্ররা দুর্নীতিতে জড়িয়ে যাচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখার কথাও বলছেন কেউ কেউ। বলা হচ্ছে, ছাত্রদের কর্মকাণ্ডে যদি সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন থাকে তাহলে এই সরকার জনগণের আস্থা হারাবে।
সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার দায় সরকারকেই নিতে হবে। সরকার সংস্কারের অনেক পরিকল্পনা নিলেও ক্ষমতা গ্রহণের সাত মাস পরেও সংস্কার দৃশ্যমান নয়। দ্রব্যমূল্য কিছুটা সহনশীল হলেও নাগরিক সেবা প্রাপ্তিতে ভোগান্তি কমেনি। জন্মসনদ, মৃত্যুসনদ ও নাগরিক সনদের জন্য সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলাগুলোতে জনপ্রতিনিধিত্ব নেই। বিশৃঙ্খলভাবে চলছে ইউনিয়ন পরিষদ। ১৮ কোটি জনগোষ্ঠীর এই দেশে এত দীর্ঘ সময় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো জনপ্রতিনিধি শূন্য থাকলে দেশে একটি অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব নয়। দেশের মানুষ মনে-প্রাণে এই সরকারের সফলতা কামনা করে। কাজেই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় সরকারকে সতর্কতার সাথে পা ফেলতে হবে। যেকোনো ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসতে পারে।
অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার চাইলেই সংস্কার কার্যক্রমকে শক্ত হাতে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে আবার চাপের মুখে দায়সারা নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায়ও নিতে পারে। সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করলে সংস্কার কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে রাজনৈতিক মীমাংসা জরুরি। দ্রুত অনিশ্চয়তা কাটিয়ে উঠতে না পারলে নতুন রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হবে।
রাজনৈতিক ডামাডোলের কারণে দীর্ঘ দিন ধরে তৃণমূল নেতৃত্বশূন্য থাকলে নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। তৃণমূলে অসন্তোষ দূর করার জন্য দ্রুত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের আয়োজন করা দরকার। তাহলে মানুষের মনে আশার সঞ্চার হবে। পর্যায়ক্রমে স্থানীয় সরকারের সবগুলো নির্বাচন যদি অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে হয় তাহলে দলীয় প্রভাবমুক্তভাবে মানুষ ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারবে। অতীতে দলীয় সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন কখনো সুষ্ঠু হয়নি। একটি সুন্দর, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন উপহার দিয়ে এই অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার তাদের নিরপেক্ষতা, সক্ষমতা প্রমাণ করুক। জনদুর্ভোগ নিরসনে কিভাবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন আয়োজন করবে সরকারকে তার উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক