মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষক সঙ্কট কমতে পারে শিক্ষার্থী ভর্তির সিট

Printed Edition

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের বিভিন্ন সরকারি মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষক সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এতে করে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে শিক্ষার্থী ভর্তির সিট কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে বর্তমানে সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে মোট ৬ হাজার ৪৪৬ শিক্ষক পদের ২ হাজার ৭০০টি পদ শূন্য। সবচেয়ে বেশি সঙ্কট রয়েছে অধ্যাপক পদের ক্ষেত্রে। অধ্যাপকের মধ্যে ৬৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ পদ শূন্য রয়েছে। এ ছাড়াও সহকারী অধ্যাপকের ২ হাজার ৭৩৫টি পদের মধ্যে ১ হাজার ৬৩৪টি এবং সহযোগী অধ্যাপকের ২ হাজার ৪৫৩টি পদের মধ্যে ১ হাজার ২৫০টি শূন্য রয়েছে। এর আগে দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এমবিবিএস কোর্সে ১ হাজার ৩০টি আসন বাড়িয়েছিল, যার ফলে সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে মোট আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ হাজার ৩৮০টি। তবে আগামী বছর থেকে এই সংখ্যা কমানো হতে পারে এমন আভাস পাওয়া গেছে।

এ দিকে শিক্ষক সঙ্কট নিরসনের দাবিতে গত ফেব্রুয়ারিতে সাত দিনের কর্মবিরতি পালন করেছিল বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীরা। তবে এখনো সঙ্কট কাটেনি। কলেজটিতে ৩৪৩টি শিক্ষকের পদের বিপরীতে বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র ১৩৭ জন। বিশেষ করে অধ্যাপকের ৫৩টি পদের মধ্যে কর্মরত রয়েছেন মাত্র চারজন।

সূত্র মতে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুসারে মানসম্মত শিক্ষা পাচ্ছেন না অনেক মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীরা। অনেক কলেজেই লেকচার ক্লাসে ২৩৪ জন শিক্ষার্থী একসাথে পড়েন, যেখানে আদর্শ গাইডলাইনে গ্রুপ স্টাডির জন্য ১৫ থেকে ২০ জন থাকার কথা থাকলেও শিক্ষক সঙ্কটের কারণে সেটি ৪০ জনের গ্রুপে সীমাবদ্ধ রাখতে হয়। আগে যা ৬০ থেকে ৮০ জনের গ্রুপ ছিল। ফলে শিক্ষার মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, শিক্ষকের এই সঙ্কট শুধু শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজেই নয়, দেশের সব সরকারি মেডিক্যাল কলেজেই একই অবস্থা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমসের (এমআইএস) সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, দেশের সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোর ৪২ দশমিক ৬০ শতাংশ শিক্ষক পদ শূন্য রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জেলায় জেলায় মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অপ্রয়োজনে অতিরিক্ত মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন করলেও অবকাঠামো ঘাটতি, শিক্ষক ঘাটতি আছে। অনেক মেডিক্যাল কলেজের সাথে হাসপাতাল নেই। এসব সঙ্কটের কারণে সরকারি মেডিক্যাল থেকে অদক্ষ ডাক্তার বের হচ্ছে।

বিশিষ্ট জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা: রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, মেডিক্যাল কলেজগুলোতে শিক্ষক সঙ্কট দীর্ঘদিনের সমস্যা। এটি সমাধান না হলে মানসম্মত চিকিৎসক তৈরি হবে না, ফলে রোগীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ড. মো: সাইদুর রহমান বলেন, মেডিক্যাল কলেজে একজন শিক্ষক তৈরি হতে ৫-৭ বছর সময় লাগে। এনাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, ফার্মাকোলজি, কমিউনিটি মেডিসিন, মাইক্রোবায়োলজি, ফরেনসিক মেডিসিন ও ভাইরোলজি এই আটটি বেসিক বিষয়ের শিক্ষক সঙ্কট সবচেয়ে বেশি। তিনি আরো বলেন, ‘গাইনি ও কার্ডিওলজির মতো ক্লিনিক্যাল বিষয়ে তেমন সঙ্কট নেই। কিন্তু বেসিক বিষয়ের ক্ষেত্রে গবেষণা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ কম থাকায় শিক্ষার্থীদের এসব বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নেয়ার হার কম। আমরা বেসিক সাবজেক্টে শিক্ষক তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছি, তবে এটির ফল পেতে ৩-৫ বছর সময় লাগবে।

উল্লেখ্য, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে আওয়ামী লীগ সরকার এমবিবিএস কোর্সে ১ হাজার ৩০টি আসন বাড়িয়েছিল, যার ফলে সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে মোট আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ হাজার ৩৮০টি। তবে শিক্ষক সঙ্কট না কাটলে আগামী বছর থেকে এই সংখ্যা কমানো হতে পারে।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের (ডিজিএমই) মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা: নাজমুল হোসেন জানান, আগের সরকার পরিকল্পনা ছাড়াই নতুন মেডিক্যাল কলেজ চালু করেছে এবং আসন সংখ্যা বাড়িয়েছে, কিন্তু সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় অবকাঠামো বা শিক্ষকের ব্যবস্থা করা হয়নি। তিনি বলেন, মেডিক্যাল শিক্ষার ন্যূনতম মান বজায় রাখতে হলে ৫ হাজার ৩৮০ আসন রাখা সম্ভব নয়। অনেক মেডিক্যাল কলেজে এমনকি ২০০ শিক্ষার্থীর জন্য যথাযথ ক্লাসরুমও নেই, অথচ সেখানে ২৫০ জন পর্যন্ত ভর্তি করা হয়েছে। যেখানে যতটুকু ম্যাক্সিমাম ক্যাপাসিটি আছে তার বেশি যেন স্টুডেন্ট না থাকে সেটা নিশ্চিত করা হবে। তিনি আরো বলেন, সরকারি মেডিক্যাল কলেজের পাশাপাশি মানহীন মেডিক্যাল কলেজগুলো নিয়েও কাজ করা হচ্ছে। আমরা মেডিক্যাল কলেজগুলো সরেজমিন দেখে সিদ্ধান্ত নেবো। মেডিক্যাল কলেজ বন্ধ করে দেয়ার চেয়ে সিট সংখ্যা কমানো সহজ। সিট সংখ্যা কমানোটা এক ধরনের শাস্তি, এর ফলে তাদের ব্যবসাও কমে যাবে। দেশের ৩৭টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজের মধ্যে ১৪টি সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এগুলোর ত্রুটি চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।