ফিলিস্তিনিদের রেখেই আরবদের গাজা পুনর্গঠন পরিকল্পনা
Printed Edition
- আজ আরব সম্মেলনে মিসরের পরিকল্পনা পেশ
- রমজানে গাজায় দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা
ফিলিস্তিনিদের রেখেই গাজা পুনর্গঠনে মিসরের পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে এবং আজ মঙ্গলবারের আরব সম্মেলনেই সেটি উপস্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বদর আবদুল আতি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর গাজার ফিলিস্তিনিদের অন্যত্র সরিয়ে দিয়ে ভূখণ্ডটিকে ওয়াশিয়ংটনের দখলে নিয়ে আসার প্রস্তাব করেছিলেন।
আরব দেশগুলো সাথে সাথে ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। যুক্তরাষ্ট্রের ওই প্রস্তাবের পাল্টায় মিসর ফিলিস্তিনিদের রেখেই গাজা পুনর্গঠনে পরিকল্পনা বানানোর কাজে হাত দেয়, জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
রোববার আবদুল আতি জানান, মিসর তাদের এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সমর্থন ও তহবিল চাইবে। তিনি গাজার পুনর্গঠন, বিশেষ করে অর্থায়নে ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার প্রয়োজনীয়তার কথাও জোর দিয়ে বলেন। আরব সম্মেলনে পরিকল্পনাটি গৃহীত হলে আমরা বড় বড় দাতা দেশগুলোর সাথে নিবিড় আলোচনা শুরু করব, ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কমিশনার দুবরাভকা সুইকার সাথে এক সংবাদ সম্মেলনে এমনটাই বলেন আবদুল আতি।
মিসরের এ মন্ত্রী জানান, মঙ্গলবারের সম্মেলনের পর ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোর জোট ওআইসির সদস্য দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা পরিকল্পনাটি কীভাবে উপস্থাপন করা হবে তা নিয়ে আলোচনায় বসবেন। তিনি বলেছেন, আরব সম্মেলনের ফল বিশ্বের কাছে সম্ভব সবচেয়ে সেরা উপায়ে উপস্থাপন নিশ্চিত করব আমরা। যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের মেয়াদ বাড়াতে হামাসের আপত্তিকে কারণ দেখিয়ে ইসরাইল রোববার গাজায় সব ধরনের মানবিক সহায়তার প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের এ পদক্ষেপ নতুন করে উত্তেজনা বাড়াবে। আবদুল আতি বলেছেন, সবাইকে শাস্তি দেয়ার লক্ষ্যে মানবিক সহায়তাকে ব্যবহার মেনে নেয়া হবে না।
সোয়া এক বছরের যুদ্ধ শেষে মধ্য-জানুয়ারিতে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যে যুদ্ধবিরতি হয়েছে, তার ছয় সপ্তাহব্যাপী প্রথম ধাপ শনিবার শেষ হয়েছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় ধাপের সব চূড়ান্ত করতে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক মার্কিন দূত স্টিভ উইটকফ সম্প্রতি দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে আলোচনার মধ্যে প্রথম ধাপের মেয়াদ আরো ছয় সপ্তাহ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তেলআবিব সেটি মেনে নিলেও হামাস চায়, ১৯ জানুয়ারি চুক্তির শর্ত মেনে নির্দিষ্ট সময়ে দ্বিতীয় ধাপ শুরু করতে। মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, তিনিও জানুয়ারিতে হওয়া সমঝোতা অনুযায়ী চুক্তির দ্বিতীয় ধাপ কার্যকর হওয়া দেখতে চান। আবদুল আতি বলেছেন, কঠিন, তবে সদিচ্ছা আর রাজনৈতিক দৃঢ়তা থাকলে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।
যুদ্ধবিরতির পর ইসরাইলি হামলায় নিহত শতাধিক
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে ইসরাইলের হামলায় আরো চারজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো কয়েকজন। গাজায় গত ১৯ জানুয়ারি থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে এবং এরপর থেকে অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডটিতে ইসরাইলি হামলায় নিহত হয়েছেন শতাধিক ফিলিস্তিনি। এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা আনাদোলু।
বার্তাসংস্থাটি বলছে, রোববার গাজায় ইসরাইলি সেনাবাহিনীর গুলিতে কমপক্ষে চার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গত জানুয়ারিতে যুদ্ধবিরতি এবং বন্দিবিনিময় চুক্তি হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরাইলের হামলায় ১১৬ জন নিহত হয়েছেন বলে ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভূখণ্ডজুড়ে একাধিক এলাকায় ইসরাইলি হামলায় আরো ছয় ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন। ফলে গত ১৯ জানুয়ারি থেকে বিভিন্ন ইসরাইলি হামলায় আহত হয়েছেন ৪৯০ জনেরও বেশি মানুষ। আনাদোলু বলছে, দক্ষিণ গাজা উপত্যকার পূর্ব খান ইউনিসের আল-ফারহিন এলাকায় ইসরাইলি ড্রোন হামলায় একজন নারী নিহত এবং আরো দুইজন আহত হয়েছেন বলে একটি চিকিৎসা সূত্র জানিয়েছে। দক্ষিণ গাজার রাফাহতেও ইসরাইলি স্নাইপারের গুলিতে আরেক ফিলিস্তিনি নিহত এবং দু’জন আহত হয়েছেন এবং উত্তরের শহর বেইত হানুনে ড্রোন হামলায় আরো দুইজন প্রাণ হারিয়েছেন। ইসরাইলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তাদের বাহিনীর কাছাকাছি কাজ করছে এমন সন্দেহভাজনদের লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে।
গত ১৯ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তির ছয় সপ্তাহের প্রথম পর্যায় গত শনিবার মধ্যরাতে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়েছে। তবে গাজা যুদ্ধের অবসান ঘটাতে চুক্তির দ্বিতীয় ধাপে যাওয়ার বিষয়ে রাজি হয়নি ইসরাইল।
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বিনিময়ে কিছু না দিয়ে বা চুক্তির সামরিক ও মানবিক বাধ্যবাধকতা পূরণ না করে যতটা সম্ভব ইসরাইলি বন্দীদের মুক্তির জন্য প্রাথমিক বিনিময় পর্ব বাড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। তবে হামাস এই ধরনের কোনো শর্তের অধীনে অগ্রসর হতে অস্বীকার করেছে এবং জোর দিয়ে বলেছে, ইসরাইলকে যুদ্ধবিরতির শর্তাবলী মেনে চলতে হবে এবং অবিলম্বে দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য আলোচনা শুরু করতে হবে, যার মধ্যে গাজা থেকে ইসরাইলের সেনাবাহিনীর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার এবং যুদ্ধের সম্পূর্ণ অবসানের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
রমজানে গাজায় দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা
রমজান মাসে গাজার মানুষদের জন্য তীব্র খাদ্যসঙ্কট ও দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ ইসরাইল ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডটিতে সব ধরনের মানবিক সহায়তা প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে। জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরের এক নারী সতর্ক করে বলেছেন, এতে দুর্ভিক্ষ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। জাতিসঙ্ঘ এবং বিভিন্ন দেশ ইসরাইলের এই সিদ্ধান্তের কঠোর নিন্দা জানিয়েছে। মিসর, কাতার ও জর্ডান এটিকে যুদ্ধবিরতি চুক্তি ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
আলজাজিরা জানায়, গাজায় চলমান যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের সময়সীমা বাড়ানোর ইসরাইলি দাবিকে প্রত্যাখ্যান করায় হামাসের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে ইসরাইল। শনিবার ওই চুক্তির প্রথম পর্যায় শেষ হওয়ার পর ইসরাইল মানবিক সহায়তা প্রবেশ বন্ধ করে দেয়। হামাস ইসরাইলের এই শর্তকে ‘চাপ প্রয়োগের কৌশল’ আখ্যা দিয়ে বলেছে, যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশ করতেই হবে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু হামাসকে আরো কঠোর পরিণতির হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। ইসরাইলি গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, সরকার গাজায় পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করার পরিকল্পনা করছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনস (সিএআইআর) বলেছে, গাজায় মানবিক সহায়তা বন্ধ করা ইসরাইলি নেতাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যুদ্ধাপরাধ মামলার প্রমাণ আরো শক্তিশালী করবে। সংগঠনটি নেতানিয়াহুকে ‘অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী’ বলে উল্লেখ করে বলেছে, রমজান মাসে গাজার বেসামরিক জনগোষ্ঠীর জন্য মানবিক সহায়তা বন্ধ করা স্পষ্টতই একটি যুদ্ধাপরাধ এবং ইসরাইলের গণহত্যার ইচ্ছার আরেকটি প্রমাণ। আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট ফেডারেশন সতর্ক করেছে, ইসরাইলের এই সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিনিদের আবারো চরম সঙ্কটের মধ্যে ফেলেছে। গাজায় নিরাপদ ও বাধাহীনভাবে মানবিক সহায়তা প্রবেশের আহ্বান জানিয়েছে তারা। মানবাধিকার সংস্থা অ্যাকশন ফর হিউম্যানিটি ইসরাইলের এই পদক্ষেপকে ‘গণযন্ত্রণা’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেছে, এটি নিষ্ঠুরতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এটি পরিকল্পিত, কাঠামোবদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন। নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল বলেছে, ইসরাইলের নতুন অবরোধ গাজার বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে ধ্বংসের একেবারে শেষ সীমায় ঠেলে দেবে। সংস্থাটি ইসরাইলকে অবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার আহ্বান জানিয়েছে।