স্কাই নিউজকে ড. ইউনূস

হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিচার হবেই, কোনো সন্দেহ নেই

নয়া দিগন্ত ডেস্ক
Printed Edition
1st-1
যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্কাই নিউজকে সাক্ষাৎকার দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস : সংগৃহীত

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, শেখ হাসিনার বিচার হবেই, এতে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু হাসিনাই নয়, তার সহযোগীদেরও বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। বুধবার প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন স্কাই নিউজের এশিয়া অঞ্চলের সংবাদদাতা কর্ডেলিয়া লিঞ্চ।

ড. ইউনূস বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে হাসিনা ও তার সহযোগীদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। কারণ সব তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। যদিও সে এখন বাংলাদেশে নেই, প্রশ্ন হচ্ছে আমরা তাকে বাংলাদেশে আনতে পারব কি না। সেটি নির্ভর করছে ভারত ও আন্তর্জাতিক আইনের ওপর। আমরা ইতোমধ্যে ভারতকে বলেছি তাকে ফেরত দিতে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সশরীরে উপস্থিত থাকুক বা ভারতে লুকিয়ে থাকুক তার বিচার হবেই।

‘আউসটেড পিএম শেখ হাসিনা উইল স্ট্যান্ড ট্রায়াল ফর ক্রাইমস অ্যাগেইনস্ট হিউম্যানিটি, বাংলাদেশ’স ইন্টেরিম লিডার সেইজ’- শিরোনামে স্কাই নিউজের প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। কেননা হাসিনার বিরুদ্ধে তার শাসনামলে জোরপূর্বক গুমে জড়িত থাকার এবং জুলাই-আগস্টে বিক্ষোভকারীদের ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগ রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, তার বিচার হবে কি না এমন প্রশ্নের অবকাশই নেই। তার বিচার হবেই, সেটি তার উপস্থিতিতেই হোক কিংবা অনুপস্থিতিতে। শুধু হাসিনাই নয়, তার সাথে জড়িত সবারই বিচার হবে। তার পরিবারের সদস্য, ক্লায়েন্ট, তার সহযোগী, অলিগার্ক যারা তাকে সহায়তা করেছে তাদের সবাইকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।

হাসিনাকে প্রত্যপর্ণের বিষয়ে বাংলাদেশ ভারতের জবাবের অপেক্ষায় আছে। বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে দু’টি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, তারা আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে নয়াদিল্লির কাছে হাসিনাকে ফেরত দেয়ার কথা জানিয়েছেন। তবে তাতে এখনো সাড়া দেয়নি ভারত। প্রধান উপদেষ্টা জোর দিয়ে বলেছেন, শেখ হাসিনা বাংলাদেশে সশরীরে উপস্থিত থাকুক বা ভারতে লুকিয়ে থাকুক, তাকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবেই।

শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে দিতে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতকে জানানো হলেও কোনো আনুষ্ঠানিক জবাব পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আশা করব তাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। এটা একটি আইনি বিষয়। আইনগতভাবে তাকে যদি ফিরিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হয়, আন্তর্জাতিক আইন তাদের (ভারত) নির্দেশনা দেবে। আমরা এ ব্যাপারে আশাবাদী। ভারতের কাছে আমরা হাসিনাকে ফেরত পাঠিয়ে দিতে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েছি।

ড. ইউনূস বলেন, শেখ হাসিনাকে দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই শেখ হাসিনার বিচার সম্পন্ন করা সম্ভব কি না এ বিষয়ে নিশ্চয়তা দেননি তিনি। বলেন, আইনগত প্রক্রিয়া বেশ দীর্ঘ হওয়ায় সময় লাগছে।

ইউনূস জানান, হাসিনার ১৫ বছরের শাসনে বিরোধী কণ্ঠ দমনে বন্দিশালা আয়নাঘরে চলে অমানবিক নির্যাতন। এর বীভৎসতা সবাইকে শুধু হতবাকই করেনি নৃশংসতার চরম পর্যায়কে তুলে ধরেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। কোনো মানুষ আরেকজন মানুষের ওপর এমন নির্যাতন করতে পারে তা কল্পনার বাইরে। এসব বিষয় দেখে হতবাক বললে তা বলতে হয় খুবই নরম শব্দ। যাদের নির্যাতন করা হয়েছে তাদের কাছে আমি তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা শুনেছি। এগুলো হচ্ছে সবচয়ে নোংরাতম জঘন্য কাজ, যা আপনি সেখানে দেখতে পাবেন তা সবচেয়ে বীভৎস কোনো বিষয়।

যারা এসব নির্যাতনের সাথে জড়িত তাদের অনেকে দেশ থেকে পালিয়েছে; কিন্তু নির্যাতনের সাথে জড়িতদের অনেকে এখনো তৎপর, তাদের সবাইকে কেন এখনো গ্রেফতার করা সম্ভব হচ্ছে না এমন প্রশ্নের জবাবে ইউনূস বলেন, প্রত্যেকে এ ধরনের কাজের সাথে জড়িত ছিল। পুরো সরকার এ ধরনের গুম, হত্যা, নির্যাতনের সাথে জড়িত ছিল। ক্যান্টনমেন্টের মতো একটি রেস্ট্রিকটেড এলাকায় এসব আয়নাঘরে নির্যাতন চলত। পুলিশ, সেনাবাহিনী এতে জড়িত ছিল। কেউ ভয়ে এসব বলতে চাইত না। আপনি চাইলেও পার্থক্য করতে পারবেন না কে অতি উৎসাহী হয়ে ওই কাজ করেছে বা কে আদেশ পালন করেছে। জুলাই-আগস্ট মাসের বিক্ষোভকারীদের ওপর সহিংসতার জন্য শেখ হাসিনার সাথে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ও পুলিশের সদস্যরাও অভিযুক্ত। জাতিসঙ্ঘের অনুমান হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত প্রায় এক হাজার ৪০০ বিক্ষোভকারীকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এসব আয়নাঘর উন্মোচন করেছি এবং জাদুঘরে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারা নির্যাতনের সাথে জড়িত তাদের পার্থক্য করে বিচারের মুখোমুখি করতে সময় লাগছে।

যারা জুলাই আন্দোলনে জীবন দিয়েছে তাদের স্বজনরা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসনের কাছ থেকে এ হত্যাকাণ্ড, নির্যাতনের বিচার পাবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ইউনূস বলেন, আমরা চেষ্টা করছি। আমরা গ্যারান্টি দিতে পারছি না। কারণ আমরা স্বল্প সময়ের জন্য দায়িত্বে এসেছি। বিচারে আইনগত প্রক্রিয়া খুবই ধীরগতির। আমরা খুব দ্রুত এটা করতে পারছি না; কিন্তু আমরা কারা জড়িত তা চিহ্নিত করছি। তাদের বিচারের আওতায় আনার চেষ্টা করছি। যারা গুম, খুন ও নির্যাতনের সাথে জড়িত তাদের অনেককে এখনো চিহ্নিত করা যায়নি। আমরা আমাদের চেষ্টার সর্বোচ্চটাই করার চেষ্টা করছি। আমাদের মেয়াদের সময় যতটা সম্ভব আমরা করব, বাকিটা একটা প্রক্রিয়ার ভেতরে রেখে যাওয়ার চেষ্টা করছি যাদের পরবর্তী সময়ে যাতে বিচার করা সম্ভব হয় এবং এভাবে তাদের বিচারের কাজ এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি। অভিযুক্তদের সংখ্যা এবং পরিসর বিবেচনায় নিয়ে বিচারে সময় নেয়া হচ্ছে বলে জানান ইউনূস। তিনি বলেন, হাসিনার পুরো সরকারই এই অপরাধের সাথে জড়িত ছিল।

অধ্যাপক ইউনূস ভুক্তভোগী পরিবারের কাছে দ্রুত বিচারের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, দোষীদের বিচারের প্রক্রিয়া তার আমলে শেষ হবে কি না তা স্পষ্ট নয়। এ ছাড়া স্কাই নিউজকে ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হতে পারে বলে জানান ড. ইউনূস। তিনি বলেন, কোনো কোনো অপরাধীকে শাস্তি দেয়া হবে, কারও বিচারিক কার্যক্রম চলমান থাকবে, কিছু থাকবে পলাতক।

প্রশ্ন করা হয়- শেখ হাসিনার ভাগ্নি ও যুক্তরাজ্যের সাবেক অর্থনীতিবিষয়ক মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর তাকে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ করা উচিত কি না? জবাবে ইউনূস বলেন, বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি প্রমাণিত হলে তাকে বিচারের জন্য দেশে ফিরিয়ে আনা যাবে কি না আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত নই। বিষয়টি আইনগত। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত হওয়ার পাশাপাশি সে ব্রিটিশ নাগরিক।

টিউলিপের দুর্নীতির অভিযোগ কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং তার বিরুদ্ধে তদন্ত অব্যাহত রাখা উচিত কি না এ প্রশ্নের জবাবে ইউনূস বলেন, হ্যাঁ অবশ্যই তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলবে। দুর্নীতি দমন কমিশন যথেষ্ট গুরুত্বের সাথেই কাজটি করছে। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অবৈধ সম্পদ গড়ে তোলার বিষয়টি তদন্তে ধরা পড়ছে। তার বিরুদ্ধে যে মামলাটি রয়েছে তা গুরুতর। দেশে তার নামে প্রচুর সম্পদের হদিস পাওয়া গেছে। যার সবকিছুই ক্ষতিয়ে দেখা হবে।

রোহিঙ্গা সঙ্কট প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও সীমান্ত সেনাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। এখনো প্রচুর রোহিঙ্গা বাংলাদেশে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে ঢুকে পড়ছে। সীমান্তে রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যা ও নির্যাতন অব্যাহত থাকায় তারা বাধ্য হয়ে অনেকটা পদ্ধতিগতভাবেই বাংলাদেশে ছুটে আসছে। তাদের সংখ্যা নির্ধারণের জন্যে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটছে, মাদক চোরাচালান ছাড়াও প্যারামিলিটারি ধরনের তৎপরতা বাড়ছে। এগুলো সহজ বিষয় নয়। এ জন্য আমরা চাই একটা সেফজোন নিশ্চিত করতে। মানবিক একটা করিডোরের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা যাতে তাদের দেশে ফিরে যেতে পারে আমরা তা চাই। আমাদের ভূখণ্ডে যেমন আমরা তাদের নিরাপদে রাখার চেষ্টা করছি, তারা যাতে তাদের দেশে ফিরে যেতে পারে সে জন্য সেখানেও তাদের জন্য একটা সেফজোন তৈরি করা প্রয়োজন।

ইউনূস বলেন, মিয়ানমারের বিদ্রেহী গোষ্ঠীগুলোর সাথে একটি নিরাপদ অঞ্চল তৈরির সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। যেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তাদের মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে দেয়া যায়। রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশের কক্সবাজার অঞ্চল যে বড় ধরনের সমস্যায় পড়েছে তা স্বীকার করে ইউনূস বলেন, কক্সবাজার বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থীশিবিরের একটি। যেখানে আনুমানিক ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণাথী আশ্রয় নিয়েছেন।