দিগন্ত সাহিত্য কবিতা

Printed Edition

হাই হাফিজ

স্পর্শহীন সুন্দর

তোমাকে অনেকবার দেখেছি, কতবার দেখেছি,

কাছে থেকে, দূরে থেকে, সামনা সামনি দেখেছি

ছবিতে দেখেছি, বাস্তবে দেখেছি,

অনুভূতিতে, স্বপ্নে, কল্পনায় দেখেছি

প্রখর রোদে, প্রভাতের আলোয় দেখেছি

হাড় কাঁপানো শীতে, বৃষ্টিতে ভেজা দেখেছি

গোধূলির আলো-আঁধারিতে, নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়

নিঝুম রাতে রূপালী জোছনাধারায় দেখেছি,

মনের আয়নাতে, অন্তর্চোখে দেখেছি।

শুধু স্পর্শ করে দেখিনি বলেই

তুমি এতটা সুন্দর!

গোলাম রব্বানী টুপুল

কালের ইজেল

একটা নিঃশব্দ দুপুর

আঁকাবাঁকা পথ হেঁটে ছন-ছাওয়া ঘর

শ্যামল ঝোপের পাশে খুদেপানা-জল

লতানো কলমির ডগায়

গিঁটে গিঁটে তার বেগুনি কুসুম

স্নিগ্ধ বহমান বাতাসে থরোথরো কম্পন,

অচেনা গাঁয়ের পাশে

বয়ে চলা নদী- চলে নিরবধি।

বনে বনে কত জেগে ওঠে মায়া

ইন্দ্রজালের ফাঁদে শত সে পাতা

ঝরে পড়ে ঝিলিমিলি তালে

হেঁটে যেতে যেতে দেখি শতকালে।

আবারো থমকে দাঁড়াই!

ছবির আধারে দেখি রঙের কোলাজ

ছড়ায়ে ছিটায়ে আছে চারিধারে,

এ যে কালের ইজেলে টাঙানো ক্যানভাস!

মোহাম্মদ আবুল হোসেন

অভিশাপ

জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছি

বোধহীন, দৃষ্টিহীন সময় কেটে যাচ্ছে

এন্টিবায়োটিক কেমিক্যালের ঝাঁঝালো গন্ধ

এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে কোষ থেকে কোষ

নিউরন ঘুমিয়ে গেছে- আর আমি?

লাশকাটা ঘরে যেমন পড়ে থাকে দেহ

হ্যাঁ, ঠিক তারই মতোই পড়ে আছি

অথচ আমার তো প্রজাপতি হবার কথা ছিল

এই বসন্তদিনে! শোলকির সাথে ছিল আড়ি-

‘আমার পুতুলের বিয়েতে না এলে কথা বন্ধ!’

শোলকি কি পুতুলের বিয়ে সাজিয়ে বসে আছে

আমার অপেক্ষায়?

জানি না, কিচ্ছু জানি না তার

আমি এখন এক জীবিত-মৃত।

কয়েকটা দিনে কী হয়েছে- আমার লালি খেয়েছে?

কোকিল কি তার গান থামিয়েছে

জুলেখার মুখ দেখি না কতদিন!

বিছানায় পড়ে আছি লাশ- একটি তাজা লাশ

খবরের কাগজে ছবি আমার, টেলিভিশনেও

মুহূর্তে সয়লাব আমি- অথচ নিজেই জানি না কিছু তার!

আঠারো কোটির কাছে রেখে যাচ্ছি আমার অভিশাপ

‘যদি পারো মানুষ হও। যদি মানুষ হও,

যদি একটি ফুলের কথা মনে পড়ে,

আমার ছবিটির দিকে তাকিও।

অভিশাপ দিয়ে গেলাম নরপিশাচদের জন্য-

যার কাছে মূল্যহীন মা, বোন, মেয়ের সম্মান

কী অভিশাপ দেবো?- সে ভাষা আজ অন্তর্হিত

আমার মুখ স্তব্ধ। বিছানায় পড়ে আছি লাশ

আমার তো ভাষা থাকতে নেই।

কী দেবো অভিশাপ-

আমি এখন আঠারো কোটি-

আঠারো কোটি অভিশাপ দেবে আমার হয়ে!’

শারমিন নাহার ঝর্ণা

উড়ে যাচ্ছে স্নেহ মায়া

জলীয় বাষ্পের মতো উড়ে উড়ে

হারিয়ে যাচ্ছে স্নেহ মায়া,

মানুষের হৃদয় এখন হিংস্র পাথরের কারুকার্য

সম্প্রীতির গ্রেনেড দিয়েও ভাঙা যায় না।

বজ্রপাতের শব্দে কিছু লোক শামুকের মতো

গুটিয়ে থাকে আড়ালে আবডালে।

রিক্ত হস্তে ঘরে ফেরে প্রতিদিন মানবতা,

অট্টালিকায় মহা সুখে দাঁত বের করে

খিলখিল শব্দে হাসছে হিংস্রতা, বর্বরতা

আমরা নীরব দর্শক মুখে নেই কোনো কথা!

সাজ্জাদ সাদিক

নদী রক্ষায় সোচ্চার হোন

প্রকৃতি মানুষের মাঝে এসে মরে যায়

নয়তো দূষণের প্রকট রোগে আক্রান্ত হয়ে

ধূসর অনুর্বর, পরিত্যক্ত নিষ্ফল হয়ে ওঠে

কিংবা লাভ করে দীর্ঘকালীন বন্ধ্যত্ব

সুফল লাভ করা হয়ে ওঠে তখন দুঃসাধ্য।

এই যে আমাদের নদীমাতৃক দেশ, নৈসর্গিক সম্পদ

আমরা কি পেরেছি সুস্থ স্রোতস্বিনী উপহার দিতে

আমাদের মাতৃভূমিকে?

কোথাও অবৈধ বালু উত্তোলন, নদীভাঙন

কোথাও নদী ভরাট, কল-কারখানা স্থাপন

তার ওপর ভিনদেশীয় আগ্রাসন

তারা কি আমাদের নদীগুলোকে বাঁচতে দেবে না?

আমরা কি ভাতের অভাবে মরবো উপকূলে

নাকি চাল আমদানি করব মোটা দরে

আর ইলিশ রপ্তানি করব ট্রাক ভরে?

এদিকে আমার কৃষক ভাই দুর্ভিক্ষে মরবে

ফসলের অভাবে!

আইনাল হক

ঘোর অমানিশা

চরম দুর্ভাগ্য কাঁধে গুটিসুটি মেরে বসে থাকে বন মোরগ

নতজানু ইতিহাস পালকের মতো খসে পড়তে থাকে বেওয়ারিশ শরীর থেকে।

কী নিদারুণ বাস্তবতা!

কী নিদারুণ বীভৎসতা!

সংস্কৃতির চোখের নিচের কালো দাগ পড়ে ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের কথা সহজেই অনুমান করা যায়।

মুক্তচিন্তার মুখোমুখি দাঁড়ানো বালিভর্তি ট্রাক আমাদের

দৈন দশার কথা স্মরণ করে দেয় বারবার।

হোসাইন মুহাম্মদ মুরাদ

স্বপ্নহীন শিশুকাল

খেলাঘর এখনো দাঁড়িয়ে; কিন্তু শিশুটির হাসি নেই,

পুতুলের চোখেও জমে আছে অব্যক্ত আতঙ্ক।

চাঁদ আলো দেয়, বাতাস বইছে আগের মতো,

কিন্তু একটি শ্বাসরুদ্ধ দেহ আজ মাটির নিচে।

শব্দ ছিল, আর্তনাদ ছিল, নক্ষত্ররা সাক্ষী,

তবু পৃথিবী শুনতে পেল না, অথবা শুনেও চুপ রইল।

বিচারের কাঁটা নড়ল না, শকুনেরা রয়ে গেল অবিকল,

অপরাধীর চোখে এখনো সাহসের আগুন।

একটি শিশুর মৃত্যু, একটি সভ্যতার লজ্জা,

তবু কাল আবার সূর্য উঠবে নির্বিকার ভঙ্গিতে।