কেমন হওয়া উচিত শিক্ষাব্যবস্থা
Printed Edition

ড. মো: কামরুজ্জামান
যে শিক্ষা মানুষের আত্মা ও দেহকে এক সুন্দর সামঞ্জস্যময় পরিণতিতে পৌঁছিয়ে এ জগতের রূপ-রস-গন্ধকে নৈতিকতার সীমার মধ্যে উপভোগ করার যোগ্যতা দান করে, সেই শিক্ষাই মানুষের প্রকৃত শিক্ষা। যে শিক্ষা প্রাকৃতিক শক্তিসমূহকে মানবতার উন্নতি ও নৈতিকতার বিকাশে প্রয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করে, তাই মানুষের উপযোগী শিক্ষা। আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উন্নতি দান করা সত্ত্বেও যে শিক্ষা মনুষ্যত্ব ও আত্মার উন্নতিকে ব্যাহত করে তা প্রকৃতপক্ষে মানব-ধ্বংসী শিক্ষা, তাকে কিছুতেই মানুষের উপযোগী শিক্ষা বলা চলে না
আমাদের দেশে ‘ইসলামী শিক্ষা’ কথাটি অস্পষ্টতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। ইসলামী শিক্ষা বলতে এদেশে প্রচলিত প্রাচীন পদ্ধতির মাদরাসা শিক্ষাকেই বোঝানো হয়ে থাকে, যেখানে সময়োপযোগী শিক্ষা কারিকুলাম বলতে গেলে একেবারেই অনুপস্থিত। এ কারণে সমাজে উন্নতি ও মর্যাদা লাভের উদ্দেশ্যে সচেতন ও উচ্চশিক্ষিত অভিভাবকরা তাদের সন্তানকে মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে রাজি হন না। বিপরীতে দেশে প্রবর্তিত আধুনিক শিক্ষাকেই আমরা আদর্শ শিক্ষা মনে করে থাকি। যদিও কোনো ইসলামপছন্দ মানুষ সচ্ছন্দে সন্তুষ্টচিত্তে এ ধরনের শিক্ষাব্যস্থা সমর্থন করেন না। এমতাবস্থায় যারা ইহ ও পরজাগতিক জীবনে মর্যাদাশীল হতে চায়, তারা এ দু’টি শিক্ষাব্যবস্থার কোনোটিকেই পূর্ণাঙ্গ আদর্শ শিক্ষা বলে স্বীকার করেন না। দেশের স্বাধীনতার বয়স ৫৪ বছর। অধিকাংশ সময় ধরে দেশটি শাসন করেছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সরকার বিগত ১৭ বছরে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেছে। ফলে দেশের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থায় সঙ্কট চরমে পৌঁছেছে। এ সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় রাষ্ট্রের হাল ধরেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার কাছে এ শিক্ষাসঙ্কট থেকে জাতি মুক্তির আশা করছে। মুক্তিলাভের এ আকাক্সক্ষা থেকেই কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এ আলোচনার অবতারণা করছি। প্রথমত, শিক্ষা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। প্রয়োজনীয় গুণাবলি ও জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় তাকেই শিক্ষা বলা যেতে পারে।
আর এ ধরনের পরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থাপনা একমাত্র মানুষেরই প্রয়োজন। অন্যান্য জীব-জানোয়ারের জন্য এ ব্যবস্থার কোনো প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয়ত, মানুষের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা রচনাকালে মানুষের সঠিক পরিচয়টিও জানা দরকার। মানুষ শুধু দেহসর্বস্ব জীব নয়। মানুষকে দেহসর্বস্ব জীব মনে করলে শিক্ষাব্যবস্থায় তাদের আত্মার বিকাশ লাভের কোনো বন্দোবস্তই থাকবে না। আবার মানুষের বস্তুগত প্রয়োজনের দিকটি উপেক্ষা করাও যাবে না। একে উপেক্ষা করে একমাত্র আত্মিক উন্নতির উদ্দেশ্যে যে শিক্ষাপদ্ধতি গৃহীত হবে তা মানুষের পক্ষে কল্যাণকর হওয়াও সম্ভব নয়। মানুষ সৃষ্টিজগতের বহু রহস্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে এবং প্রত্যেক যুগেই বস্তুজগতের বিভিন্ন শক্তিকে নিজের উপকারে ব্যবহার করেছে। কিন্তু ওহির জ্ঞান ব্যতীত কোনোকালেই মানুষ তার নিজের প্রকৃত পরিচয় লাভ করতে সক্ষম হয়নি। আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে এত বিপুল শক্তির অধিকারী করেছে যে, মানুষ আজ পাখির চেয়েও দ্রুত উড়তে সক্ষম হয়েছে।
এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে বিচরণের ক্ষমতাও তারা লাভ করেছে। কিন্তু ‘প্রকৃত মানুষ’ হিসেবে দুনিয়ায় জীবনযাপন করার উপযোগী শিক্ষা থেকে আধুনিক মানুষ বঞ্চিত রয়ে গেছে। ওহির জ্ঞান থেকে দূরে থাকার কারণে মানুষ নিজেকে ভালোভাবে চিনতে পারেনি। শুধু বিবেকবুদ্ধি প্রয়োগ করে মানুষ নিজেকে চিনতে চেষ্টা করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে। অথচ শুধু বিবেক দ্বারা মানুষ নিজেকে কখনো চিনতে পারবে না। আর এ কারণেই আল্লাহ নবীদের মাধ্যমে যুগে যুগে মানুষকে আত্মজ্ঞান দান করেছেন। তাই মানুষের প্রকৃত পরিচয় পেতে হলে আমাদেরকে কুরআনের দ্বারস্থ হতে হবে। কুরআন অন্যান্য জীবের সাথে মানুষের যে ব্যবধান নির্দেশ করে তা এই যে, ‘মানুষ নৈতিক জীব’ আর অন্যান্য জীব নৈতিকতার বন্ধন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। ভালো ও মন্দ, সৎ ও অসৎ, সত্য ও মিথ্যার বিচার করার ক্ষমতা মানুষ ছাড়া আর কোনো জীবের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় না। মিথ্যা বলা যার অভ্যাস সে মানুষটিও ‘মিথ্যা বলা অন্যায়’ বলে স্বীকার করে। কিন্তু তাকে মিথ্যুক বললে সে ক্ষেপে যায়। এ একই কারণে সে ‘মিথ্যুক’ উপাধিতে ভূষিত হতে পছন্দ করে না। ‘চুরি করা খারাপ’ এ কথা স্বীকার করে বলেই চোর প্রকাশ্যে চুরি না করে গোপনে করে।
ভালো-মন্দের এই বিচারজ্ঞানই মানুষকে অন্যান্য জীব থেকে পৃথক করেছে। যারা এই মানুষের এই নৈতিক দিকের উন্নতি করার চেষ্টা করে না, কুরআন তাদের পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট বলে আখ্যায়িত করেছে। কুরআন হাত, পা, চোখ ও কানবিশিষ্ট শরীরটিকে প্রকৃত মানুষ মনে করে না। কুরআনের মতে, এ দেহ সৃষ্টির বহু পূর্বে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। কুরআনের পরিভাষায় সেই মানুষটির নাম হলো ‘রূহ’ বা আত্মা। এ আত্মাই নৈতিকতার আধার। এ আত্মাকে উন্নত করার ব্যবস্থা না করলে এ শরীর পশুর মতোই আচরণ করবে। শরীরের যত সব বস্তুগত দাবি আছে তা পূরণের জন্য মানবদেহ সব সময়ই মুখিয়ে থাকে। পেট খালি হলেই সে খাদ্যের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মানুষ সেই খাদ্য চুরি করে আনল নাকি পরিশ্রম করে অর্জন করল সে বিষয়ে পেটের কোনো মাথাব্যথা নেই। পেটের প্রয়োজন খাদ্য। অন্যায়ভাবে খাদ্য এনে দিলেও পেট নিশ্চিন্তে সেই খাদ্য খেতে থাকে। কিন্তু তখন রূহ এতে বাধা প্রদান করে। রূহ বলতে থাকে যে, কাজটা অন্যায় হচ্ছে। সুতরাং তুমি এটা খেও না। কিন্তু দেহ আত্মার কথায় কর্ণপাত করে না। উভয়ের মধ্যে একটি যুদ্ধ চলতে থাকে।
এভাবেই সৃষ্টিজগতে দেহ এবং আত্মার মাঝে বিশ্বমানের এক বিরাট যুদ্ধ চলমান রয়েছে। আত্মা ও দেহের মধ্যে অপেক্ষাকৃত যে শক্তিশালী হবে সেই এ যুদ্ধে বিজয়ী হবে। দেহ যদি অসুস্থ হয় তাহলে তার চাহিদা ক্ষীণ হয়ে পড়ে। অসুস্থ দেহ তার আকর্ষণীয় বস্তুর দিকে আর ধাবিত হতে পারে না। তেমনি বিবেক অসুস্থ হলেও তার অপরাধবোধ হ্রাস পায়। পাপ করেও তার মধ্যে অনুশোচনা জাগ্রত হয় না। উল্টো সে চাপাবাজি ও ধান্ধাবাজিতে সক্রিয় হয়ে পড়ে। এভাবে বার বার সে বিবেকের বিরুদ্ধে চলতে চলতে তার বিবেকশক্তি একেবারেই লোপ পায়। এক সময় সে নিজেকে পশুর পর্যায়ে নিয়ে যায়। তখন পরিবার, সমাজ এবং দেশ ভয়ানকভাবে ক্ষতির মুখে নিপতিত হয়। দেশে তখন রুচির দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ে। সমাজ, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বিনাশ সাধিত হয়। আমাদের বর্তমান সমাজের প্রতিচ্ছবি যার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। এমতাবস্থায় মানব প্রজন্মের সুষ্ঠু বিকাশ সাধনে দেহ ও আত্মার সমন্বয় সাধন একান্ত প্রয়োজন।
এ সমন্বিত কাঠামোর ওপরই মানবজীবনের পরিপূর্ণ শান্তি ও নিরাপত্তা নির্ভর করছে। মানুষকে যারা আত্মাবিহীন এক জড় পদার্থ মনে করেন, তারা শিক্ষাব্যবস্থাকে তৈরি করার বেলায় মানুষের শুধু বস্তুগত প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেয়। এ ব্যবস্থায় মানুষের প্রকৃত পরিচয় উপেক্ষা করা হয়। ফলে তারা মানুষকে অন্যান্য জীবের ন্যায়ই দেহসর্বস্ব জীব মনে করে এবং সেভাবেই মানবজাতির শিক্ষা কারিকুলাম তৈরি করে। পাশ্চাত্য সভ্যতা মানুষকে দেহসর্বস্ব একটি জীব মনে করে থাকে। তারা ধর্মনিরপেক্ষ ও খোদাবিমুখ বলেই আত্মাকে চেনার সুযোগ পায় না। তারা মানুষকে আত্মাপ্রধান হিসেবে বিবেচনা করে না। আর এ কারণেই ডারউইনরা মানুষকে বানরের উন্নত সংস্করণ প্রমাণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ মতাদর্শে বিশ্বাসীরা মানুষকে অন্যান্য পশুর মতো গড়ে তুলবার উপযোগী শিক্ষা কারিকুলাম তৈরি করেছে বারবার। যার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত ডারউইনের উত্তরসূরিখ্যাত বাংলাদেশী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল। বিগত ১৭ বছর যাবৎ বাংলাদেশে এ জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা জাতির ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল ডারউইনের অনুসারীরা। এ শিক্ষা দ্বারা বাংলাদেশে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটেনি। ফলে তাদের পতনের পরেও দেশের সর্বক্ষেত্রে অস্থিরতা কাজ করছে। চারিদিকে আমরা তাদের পশুত্বের বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাচ্ছি বার বার ও ক্ষণে ক্ষণে।
বিপরীতে যারা মানুষকে শুধুমাত্র আত্মসর্বস্ব মনে করেন অথবা যারা জৈবিক প্রয়োজনের দিকে মনোযোগ দেন না, তারা কেবল আধ্যাত্মিক উন্নতির উদ্দেশ্যে শিক্ষার প্রচলন করেছেন। তারাও মানুষের উপযোগী প্রকৃত শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ শিক্ষা মানুষকে যতই খোদাভীরু ও ধর্মপ্রাণ হওয়ার অনুপ্রেরণা দান করুক না কেন বাস্তব জীবনে বস্তুগত প্রয়োজনের তাগিদ তাকে ঈমানের বিপরীত পথে ঠেলে দিচ্ছে। তাই এই প্রকার শিক্ষাও মানুষের স্বভাবের বিপরীত। তাই যে শিক্ষা মানুষের আত্মা ও দেহকে এক সুন্দর সামঞ্জস্যময় পরিণতিতে পৌঁছিয়ে এ জগতের রূপ-রস-গন্ধকে নৈতিকতার সীমার মধ্যে উপভোগ করার যোগ্যতা দান করে, সেই শিক্ষাই মানুষের প্রকৃত শিক্ষা। যে শিক্ষা প্রাকৃতিক শক্তিসমূহকে মানবতার উন্নতি ও নৈতিকতার বিকাশে প্রয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করে, তাই মানুষের উপযোগী শিক্ষা। আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উন্নতি দান করা সত্ত্বেও যে শিক্ষা মনুষ্যত্ব ও আত্মার উন্নতিকে ব্যাহত করে তা প্রকৃতপক্ষে মানব-ধ্বংসী শিক্ষা, তাকে কিছুতেই মানুষের উপযোগী শিক্ষা বলা চলে না। সুতরাং বর্তমানে সময়োপযোগী একটি শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা জাতির সামনে পেশ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। শিক্ষাব্যবস্থাপনা কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে দেশবাসীরও সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। এতদসম্পর্কিত একটি শিক্ষা কারিকুলাম জাতির কাছে উপস্থাপন করা সময়ের দাবি। খুব শিগগিরই সেটি করা হবে ইনশাআল্লাহ।
লেখক : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
E-mail [email protected]