রমজানে কিছু টিপস

Printed Edition

তৌফিক আল মোবারক

এক হাদিসের বর্ণনায় মহানবী সা: হজরত জিবরাইল আ:-এর যে তিনটি দোয়ার জন্য ‘আমিন’ বলে জোরগলায় সমর্থন করেছিলেন, তার একটি ছিল ‘সেই লোকের জন্য অভিশাপ যে রমজান মাস পেয়েও তার গুনাহ মাফ করিয়ে নিতে পারেনি!’ তাই রমজান মাসেই আমরা যেন আমাদের অনাকাঙি্ক্ষত পাপাচারগুলো মোচন করাতে আল্লাহ পাকের সামনে আরো গ্রহণযোগ্যভাবে নিজেদের সমর্পণ করতে পারি, তার জন্য সঠিকভাবে প্রস্তুতি নেয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাহাবায়ে কেরাম রা: রমজানের সময়টিকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানোর জন্য এতই সচেতন ছিলেন যে, রমজানের আগের পাঁচটি মাস রমজান নিয়ে ভাবতেন এবং রমজান-পরবর্তী ছয়টি মাসই রমজানে কৃত ইবাদতগুলো আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে কি না, তা নিয়ে বিচলিত থাকতেন। আমাদেরও তাই রমজানকে যথাযথ মর্যাদায় পালন করার উদ্দেশ্যে কিছুটা পরিকল্পনা হাতে নেয়া উচিত।

রমজানে পানাহার : রমজানের দিনগুলোতে পানাহার নিষিদ্ধ বলেই যে রমজানে পানাহার নিয়ে পরিকল্পনা থাকার প্রয়োজন নেই, এমনটি কিন্তু মোটেও সঠিক নয়; বরং অল্প যে কয়েকটি ঘণ্টা আমাদের হাতে থাকে পানাহারের জন্য, সেই সময়টিকেই যেন আমরা সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে পারি তাই একটি সুষ্ঠু, সুষম ও সঠিক পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার জন্য নিচের কিছু বিষয় মাথায় রাখতে পারি-

আমরা সাধারণত পেঁয়াজু, মরিচা, বেগুনি, সিঙ্গাড়া, সমুচা, পাকোড়া ইত্যাদি ডুবোতেলে ভাজাপোড়া খাবার দিয়েই ইফতার করতে অভ্যস্ত। অথচ স্বাস্থ্যগত দিক থেকে সারা দিন রোজা রেখে খালি পেটে এ ধরনের খাবার আমাদের জন্য যে কী পরিমাণ ক্ষতিকর তা উপলব্ধি করার জন্য আমাদের ডাক্তার হওয়ার প্রয়োজন নেই। গ্যাস্ট্র্রিক-আলসারের সুবাদে মোটামুটি সবারই কিছু না কিছু অভিজ্ঞতা ইতোমধ্যেই অর্জিত হয়ে গেছে। খালি পেটে ভাজাপোড়া না খেলে যে ইফতার করা হবে না, এমনটিও কিন্তু নয়। আমরা একটু সচেতনভাবে চেষ্টা করলেই এই ধারাটি পরিবর্তন করতে পারি। এর পরিবর্তে ফলমূল, দই ও দইজাতীয় খাবার (যেমন- দইয়ের শরবত, লাচ্চি, দইবড়া, ইত্যাদি), সিরিয়েল জাতীয় খাবার (যেমন খাবার বা রুটি ইত্যাদি) গ্রহণ করতে পারি। অনেকেই অল্প কিছু খেজুর, পানীয়, ফলমূল ইত্যাদি দিয়ে ইফতারি করে মাগরিবের নামাজের পরপরই রাতের খাবার খেয়ে ফেলেন। অনেক দেশে এভাবেই ইফতার করে থাকে। এতে ভরা পেটে মাগরিবের নামাজ পড়তে যেমন কষ্ট হয় না, তেমনি মাগরিবের নামাজটিও সময়মতোই পড়ে ফেলা যায়, অতিরিক্ত দেরিতে পড়া হয় না।

পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন। ফাস্টফুড যেমন বর্জন করা উচিত, তেমনি আমাদের খাবারের তালিকায় বেশি পুষ্টিমান আছে, এ রকম খাবার রাখা উচিত। তা ছাড়াও ফুড সাপ্লিমেন্ট, যেমন-স্পিরুলিনা নিতে পারেন। স্পিরুলিনা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রেস্ক্রাইবড একটি ফুড সাপ্লিমেন্ট, যা আমাদের দেশেও প্রচুর তৈরি হয়ে থাকে।

সারা দিন রোজা রেখে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের চোখের খিদেটা বেড়ে যায়, মনে হয় যেন অনেক কিছুই নিঃশেষ করে ফেলা যাবে নিমিষেই। প্রকৃতপক্ষে সারা দিন উপোস থেকে অতিরিক্ত ভোজন আমাদের জন্যে মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়। হাদিসেও এভাবে মহানবী সা: বলেছেন, ‘কোনো মানুষ সবচেয়ে নিকৃষ্ট যে পাত্রটি পরিপূর্ণ করতে পারে, তা হলো পেট!’ একই হাদিসে নবীজি সা: সুন্দরভাবেই আমাদেরকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন যাতে আমরা পেটের এক-তৃতীয়াংশ খাবারের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানিয়ের জন্য এবং এক-তৃতীয়াংশ খালি রাখি। অতিভোজনে কোনো দিক থেকেই কোনো কল্যাণ নেই। অপর একটি হাদিসে অল্প ও পরিমিত আহারকে উৎসাহিত করতে বলা হয়েছে, ‘যা একজনের জন্য যথেষ্ট, তা দুজনের জন্যও যথেষ্ট; যা দুজনের জন্য যথেষ্ট, তা তিনজনের জন্যও যথেষ্ট...’ আমাদের সামান্য সচেতনতার মাধ্যমেই আমরা ইফতারিতে ভুরিভোজন থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারি। এতে শরীর হাল্কা থাকায় তারাবিহর নামাজ পড়তেও সহজ হয়। পাশাপাশি গৃহিণীদের জন্যও হরেকরকম ইফতারি আয়োজনের সময় ও শ্রম থেকে কিছুটা ইবাদতে মনোনিবেশ করতে সুবিধা হয়। তাদের জন্যও ইবাদতের সুযোগ করে দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। তা ছাড়াও রোজার অন্যতম উদ্দেশ্যই হলো আমরা যেন রোজা রেখে অভুক্তদের দুঃখ বুঝি, তাই অল্প ভোজনের অভ্যাস গড়ে তোলা রোজার উদ্দেশ্যের সাথেই বেশি মানানসই।

সারা দিন রোজা রাখতে গিয়ে আমরা খুব সহজেই পানিস্বল্পতায় ভোগী। যেসব দেশে প্রচণ্ড গরম আবহাওয়া, কিংবা দীর্ঘ সময় ধরে রোজা রাখতে হয়, তাদেরও পানি স্বল্পতায় ভোগাটা স্বাভাবিক। আমাদের পক্ষে শরীরে উটের মতো পানি সঞ্চয় করে রাখারও কোনো সুযোগ নেই। তাই একটু সচেতনতার সাথেই পানিস্বল্পতা রোধের ব্যাপারে আমরা কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারি। যেমন- গুরুপাক খাবার অর্থাৎ বিরানি, পোলাও, ডুবোতেলে ভাজাপোড়া, কিংবা এমন খাবার যা শরীর থেকে পানি টেনে নেয় (নান রুটি, ইত্যাদি) তা পরিহার করা উচিত। তার পরিবর্তে ফলমূল, শাক-সবজি, মাছ, সালাদ, দই ইত্যাদি খাবার গ্রহণ করা উচিত। আর তারাবিহর নামাজের সময় সাথে করে একটি পানির বোতল রাখা যায়, যা কিছুক্ষণ পরপর আপনাকে পানিতে সিক্ত করতে সহযোগিতা করবে। তোকমার দানা, চিয়া সিড, ফলের শরবত, ডাবের পানি, শসা, তরমুজ, দই/দুধ-কলা বা এ ধরনের উপকরণগুলো ইফতার ও সাহরিসহ রাতে গ্রহণ করা যায়, যা পানি স্বল্পতা দূর করতে সহযোগী।

সবচেয়ে সক্রিয় ও ফলপ্রদ সময়টি বের করে নিন : রোজা রেখে ক্লান্ত দেহে অনেক সময় দিনের সব কাজ অন্য দিনগুলোর মতো ফলপ্রসূ নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমরা দিনের যে সময়টিতে বেশি কর্মঠ ও বেশি সতেজ থাকি, সেই সময়েই আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সেরে নিতে পারি। অনেকের ক্ষেত্রে তা দিনের প্রথম ভাগে হতে পারে, আবার অনেকের ক্ষেত্রে তা অন্য সময়টাও হতে পারে। আপনি নিজেই নিজের সক্রিয় সময়টি বের করে নিয়ে কাজগুলো সেরে ফেলতে পারেন।

  • (চলবে)