আরব নেতাদের গাজা পরিকল্পনার বিরোধিতা যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইলের

বিকল্প প্রস্তাব অনুমোদন আরব বিশ্বের

নয়া দিগন্ত ডেস্ক
Printed Edition

গাজা পুনর্গঠনের জন্য আরব নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনে প্রস্তাবিত পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছে হোয়াইট হাউজ। একই দিন কায়রোতে অনুষ্ঠিত এক জরুরি শীর্ষ সম্মেলনে আরব নেতারা ৫৩ বিলিয়ন ডলারের গাজা পুনর্গঠন পরিকল্পনা অনুমোদন করেছেন। আরব নেতাদের বিকল্প প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায় হোয়াইট হাউজ জানিয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজার ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের সরিয়ে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন ‘রিভেরা’ গড়ে তোলার প্রস্তাবেই অটল আছেন। খবর : আলজাজিরা, আনাদোলু ও বিবিসি।

মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র ব্রায়ান হিউজেস তুরস্কের বার্তাসংস্থা আনাদোলুকে পাঠানো এক ইমেইল বার্তায় বলেন, ‘বর্তমান প্রস্তাবটির সাথে গাজার বাস্তবতার সামঞ্জস্য নেই। গাজা বর্তমানে বসবাসের অযোগ্য। এর বাসিন্দারা ধ্বংসাবশেষ ও অবিস্ফোরিত অস্ত্রে পূর্ণ এমন একটি অঞ্চলে বসবাস করতে পারে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হামাসমুক্ত গাজা পুনর্গঠনে অটল। আমরা এই অঞ্চলে শান্তি ও সমৃদ্ধি আনতে আরো আলোচনা চালিয়ে যেতে চাই।’

এর আগে গত মঙ্গলবার মিসরের কায়রোতে এক জরুরি আরব শীর্ষ সম্মেলনে ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূমি থেকে বাস্তুচ্যুত না করে গাজা উপত্যকা পুনর্নির্মাণের জন্য মিসরের ৫৩ বিলিয়ন ডলারের পুনর্গঠন পরিকল্পনা গৃহীত হয়। পরিকল্পনায় তিনটি প্রধান ধাপ রয়েছে- অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা, পুনর্গঠন ও গাজা পরিচালনা। প্রথম ধাপটি প্রায় ছয় মাস স্থায়ী হবে এবং পরবর্তী দুটি ধাপ চার থেকে পাঁচ বছর ধরে চলবে।

এর লক্ষ্য হলো যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজাকে পুনর্গঠন করা, শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। এর আগে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফিলিস্তিনিদের অন্যত্র পুনর্বাসিত করে এবং গাজা ‘দখল’ করে একে ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভেরা’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন। তার এ বহুল সমালোচিত পরিকল্পনা আরব বিশ্বসহ অন্যান্য অনেক দেশ প্রত্যাখ্যান করে।

মিসরের প্রস্তাবিত যুদ্ধোত্তর পরিকল্পনা অনুযায়ী, একটি সংস্কারকৃত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ না করা পর্যন্ত হামাসকে অন্তর্বর্তী প্রশাসনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। এতে প্রায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনি গাজায় থেকেই পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ পেতেন, যা ট্রাম্পের প্রস্তাবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

এ দিকে ইসরাইলও আরব নেতাদের পরিকল্পনার কঠোর সমালোচনা করেছে এবং একে বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। ইসরাইলের মতে, এটি গাজার নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাবে না বরং হামাসের শক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে। তবে হামাস এই আরব পরিকল্পনাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে এবং অবিলম্বে ফিলিস্তিনে সংসদীয় ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান জানিয়েছে।

বর্তমান যুদ্ধবিরতি জানুয়ারি থেকে কার্যকর থাকলেও এর মেয়াদ শনিবার শেষ হওয়ার কথা। ইসরাইল ৭ অক্টোবর ২০২৩-এ হামাসের অভিযানের পর যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ানো এবং যুদ্ধের সূত্রপাতকারী বন্দীদের মুক্তির জন্য বিকল্প একটি মার্কিন প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। হামাসকে চুক্তি মানতে বাধ্য করতে ইসরাইল গাজায় খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে।

এতে যুদ্ধ ফের শুরু হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে এবং ইসরাইল সম্ভাব্য আরো কঠোর পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি দিয়েছে। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো এই সহায়তা স্থগিতের তীব্র সমালোচনা করেছে, কারণ তারা মনে করে এটি আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে দখলকারী শক্তি হিসেবে ইসরাইলের দায়িত্বের লঙ্ঘন।

গাজা পরিকল্পনা অনুমোদন : এ দিকে মিসরের রাজধানী কায়রোতে অনুষ্ঠিত এক জরুরি শীর্ষ সম্মেলনে আরব নেতারা ৫৩ বিলিয়ন ডলারের গাজা পুনর্গঠন পরিকল্পনা অনুমোদন করেছেন। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘গাজা দখল’ এবং দুই মিলিয়নের বেশি ফিলিস্তিনিকে স্থানান্তরের পরিকল্পনার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেই এ অনুমোদন দেয়া হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই সম্মেলনের শেষে আরব লিগের মহাসচিব আহমেদ আবুল গীত ঘোষণা করেন, ‘মিসরের পরিকল্পনাই এখন আরব পরিকল্পনা।’ ট্রাম্পের প্রস্তাবের বিষয়ে সরাসরি উল্লেখ না করলেও তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, ‘আরব বিশ্বের অবস্থান যে কোনো ধরনের স্থানচ্যুতি প্রত্যাখ্যান করা, তা স্বেচ্ছায় হোক বা জোরপূর্বক।’

মিসর একটি বিস্তারিত ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করেছে, যার মধ্যে ৯১ পৃষ্ঠার একটি চকচকে নথি রয়েছে। এতে পরিকল্পিতভাবে আশপাশের অঞ্চল ও বিশাল জনসমাগমের স্থানগুলোর ছবি সংযুক্ত করা হয়েছে।

এটি মূলত ট্রাম্পের ‘মধ্যপ্রাচ্য রিভেরা’ পরিকল্পনার পাল্টা পরিকল্পনা হিসেবে সামনে আনা হয়েছে। এই পরিকল্পনাটি আরব বিশ্ব এবং এর বাইরেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। নতুন পরিকল্পনাটি শুধু অবকাঠামো উন্নয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি রাজনৈতিক বিষয় এবং ফিলিস্তিনিদের অধিকারকেও গুরুত্ব দেয়। সম্মেলনে মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি বলেন, গাজার পুনর্গঠনের পাশাপাশি একটি সমান্তরাল পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

সেখানে ইসরাইলের পাশাপাশি একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আরব রাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশ এই সমাধানকেই চিরস্থায়ী সঙ্ঘাত নিরসনের একমাত্র পথ বলে মনে করে। এ ছাড়া, এই বিশাল পুনর্গঠন প্রকল্পের অর্থ সংগ্রহের জন্য আগামী মাসে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।

উপসাগরীয় কিছু ধনী দেশ ব্যয় বহনের আগ্রহ দেখালেও তারা নিশ্চিত হতে চায়, এই অবকাঠামোগুলো ভবিষ্যতে নতুন কোনো যুদ্ধে ধ্বংস হবে না।

বর্তমানে গাজায় যে ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি চলছে, তা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা আরো অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। জাতিসঙ্ঘের তথ্য অনুযায়ী, স্কুল, হাসপাতাল, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ লাইনসহ জনজীবনের মৌলিক অবকাঠামো প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। মিসরের পরিকল্পনা সম্পর্কে কায়রোতে এক ব্রিফিংয়ে অংশ নেয়া এক পশ্চিমা কূটনীতিক মন্তব্য করেন, ‘এটি পরিষ্কার, তারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে মাথায় রেখেই পরিকল্পনাটি সাজিয়েছে। এটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও সুপরিকল্পিত।’

এ পরিকল্পনার সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞরা টেকসই উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছেন। পাশাপাশি দুবাইয়ের হোটেল ডেভেলপারদের অভিজ্ঞতাও কাজে লাগানো হচ্ছে। এ ছাড়া, হিরোশিমা, বৈরুত ও বার্লিনের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরগুলো কীভাবে পুনর্গঠিত হয়েছে, সে অভিজ্ঞতা থেকেও শিক্ষা নেয়া হয়েছে। মিসরের ‘নতুন কায়রো’ প্রকল্প থেকেও অনুপ্রেরণা নেয়া হয়েছে, যেখানে মরুভূমির মধ্যে বিশাল প্রশাসনিক শহর গড়ে তোলা হয়েছে। যদিও এতে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়েছে।