প্রসঙ্গ ড্যাপ : বৈষম্য উপেক্ষা নাকি প্রহসন!

Printed Edition

বাবলু রহমান

রাজউক একাধিকবার ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) ২০২২-৩৫’ বিধিমালা সংশোধন করেছে। প্রতিবারই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বৈষম্যপূর্ণ অবস্থানকে অটুট রাখা হয়েছে। অভিযোগ উঠছে এ পরিকল্পরনায় আড়াই লাখ নিম্ন-মধ্যবিত্ত ভূমিমালিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ড্যাপের বিধিমালা পর্যবেক্ষণ করে আরো দেখা যায়, এর অনেক বিষয় পরস্পরবিরোধী। বর্তমান ভূমি উপদেষ্টা সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার (বাসস, ২৮ জানুয়ারি) বলেছেন, ‘ভূমির ওপর মানুষের অধিকার সর্বজনীন। মানুষের জীবন ভূমি ব্যবস্থাপনার সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত।’ রাজউকের ড্যাপ বিধিমালায় ১০ তলার জায়গায় ৫০ শতাংশ কমিয়ে পাঁচ তলায় নামানো হয়েছে। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, সাধারণ ভূমিমালিকদের সাথে এটা কি প্রহসন নয়? তাই অবিলম্বে ড্যাপ পরিমার্জনসহ ইমারত নির্মাণ বিধি-২০০৮ পুনর্বহালের আহ্বান জানানো হচ্ছে প্রত্যক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত অংশীজনদের তরফ থেকে।

রাজউক ড্যাপ সংশোধনীর সর্বশেষ প্রজ্ঞাপন জারি করে ১৮ নভেম্বর ২০২৪। এর মাধ্যমে জনসাধারণের পক্ষ থেকে ড্যাপের বিষয়ে সংশোধনী প্রস্তাব চাওয়া হয়। এর আগেও ড্যাপ সংশোধনী প্রস্তাব চাওয়া হয়েছিল। সংশোধনীর কথা বলা হলেও একই বিধিমালা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমলাতান্ত্রিক কথা ও জটিলতার ঘোরপ্যাঁচ দিয়ে বহাল রাখা হয়।

মূল অংশীজন ভূমিমালিকরা উপেক্ষিত

সর্বশেষ প্রজ্ঞাপনের সংজ্ঞা (৮) উপ-ধারায় বলা হচ্ছে- ‘আবেদনকারী’ অর্থ সংশ্লিষ্ট ভূমির বৈধ মালিক অথবা বৈধ মালিক কর্তৃক আমমোক্তারনামা বলে আবেদনকারী হিসেবে নিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান।’ অথচ (৮) উপ-ধারার এই সংজ্ঞাটি (১) নম্বরে সংযোজন করা উচিত ছিল। কারণ, ইমারত নির্মাণের ব্যাপারে সবার আগে প্রয়োজন- ভূমি ও ভূমিমালিক। তাই ভূমিমালিককেই মূল বা এক নম্বর অংশীজন বা স্টেকহোল্ডার হিসেবে বিবেচনার দাবি রাখে। যদিও, এই ভূমিমালিকদের স্বার্থের কথা বিধিমালা ও সংশোধনীর কোথাও উল্লেখ করতে দেখা যায়নি। ভুক্তভোগী সাধারণ ভূমিমালিকদের উপেক্ষা করা হয়েছে আগে-পরে ড্যাপের সর্বক্ষেত্রে।

ড্যাপের সর্বশেষ সংশোধনীর তৃতীয় অধ্যায়ের (৩০) ‘নগর উন্নয়ন কমিটি’তে মূল অংশীজন বা স্টেকহোল্ডার হিসেবে ভূমিমালিকদের প্রতিনিধিত্ব অন্তর্ভুক্ত রাখা উচিত। সেই সাথে দরকার সংশোধনীর নামে জনগণকে শুভঙ্করের ফাঁকির মধ্যে ঘুরপাক খাওয়ানো বন্ধ করে ভূমিমালিকদের প্রত্যাশা আমলে নেয়া।

ভবনগুলো অন্তত ২৫ তলা হওয়া উচিত

দেশের প্রথম ৪৫ তলা ভবন টিএ টাওয়ারের অবিকল নকশা বা ডামি আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচন করা হয় ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫। এ অনুষ্ঠানে উদ্যোক্তা ট্রপিক্যাল হোমসের এমডি শেখ রবিউল হক বলেন, এখনো বেশির ভাগ ভবনই ছয়-সাত তলা উচ্চতার। অথচ ঢাকার ভবনগুলো অন্তত ২৫ তলা উচ্চতার হওয়া উচিত। ১০০-১৫০ তলা ভবনও হতে হবে। কারণ, আমরা চাই না কোনো কৃষিজমি নষ্ট হোক।

রাজউক চেয়ারম্যান মে. জে (অব:) ছিদ্দিকুর রহমান সরকার সেই একই অনুষ্ঠানে বলেন, আমরা ঢাকায় ১০০ তলা ভবন নির্মাণের চেষ্টা করছি। ড্যাপ নিয়ে ভুলভ্রান্তি আছে। অচিরেই আমরা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা চূড়ান্ত করব। সেখানে বিভিন্ন এলাকায় ভবন নির্মাণ নিয়ে যেসব বৈষম্য আছে, সেটি থাকবে না।

আশার বাতি নেভাতে নয়-জ্বালানো দরকার

রাজউক চেয়ারম্যানের এই আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয়- ভবনের উচ্চতা ও দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি, ফ্লোর-ফ্ল্যাট-কক্ষের আকৃতি নকশা মালিকবান্ধব, ইউনিট ফার বাতিল, সব অঞ্চলকে সমান গুরুত্ব দিয়ে বৈষম্যমুক্তভাবে ফার সংশোধন, সেটব্যাক সহনীয় রাখার প্রত্যাশাগুলো বিবেচনায় নিতে হবে।

একই সাথে উচিত, ভবনের উচ্চতা অনুযায়ী সেটব্যাকে তিন-চার-পাঁচ কাঠার ভূমিমালিকদের বঞ্চনা বন্ধ হওয়া। এমন অনেকে প্রত্যাশা অনুযায়ী নকশা অনুমোদন না করতে পেয়ে ভগ্ন হৃদয়ে মারাও গেছেন। তাই ম্যাক্সিমাম গ্রাউন্ড কাভারেজের বিষয়টি বাদ দেয়ার কথা পুনর্বিবেচনা করা দরকার। জনঘনত্বের অজুহাতে ইউনিট সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিধি বাদ দেয়া, প্রয়োজন অনুযায়ী ও এলাকা ভিত্তিতে ইউনিট সংখ্যা ও ইউনিট সাইজ নির্ধারণ এবং ইনসেনটিভে বৈষম্য নিরসন জরুরি।

সাধারণ মানুষ অনেক কষ্টে টাকা জমিয়ে এক খণ্ড জমি কিনে বাড়ি তৈরির স্বপ্ন দেখে- শেষ বয়েসে ভাড়ার টাকায় সংসার প্রতিপালনসহ সন্তানদের শিক্ষাদান করবেন। রাজউককে সদয় হয়ে মানুষের সে আশার বাতি নিভাতে নয়- জ্বালাতে এগিয়ে আসা দরকার। দরকার রাজউকের কার্যক্রম ও দৃষ্টিভঙ্গি জনমুখী, জনবান্ধব এবং জনস্বার্থের অনুকূলে ফিরিয়ে আনা।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে, ঢাকা সিটি ভূমিমালিক সমিতির সমন্বয়ক প্রফেসর ড. দেওয়ান এম এ সাজ্জাদের কথা। বড় দুঃখের সাথে তিনি (৮ ডিসেম্বর ২০২৪) বলেছিলেন, ড্যাপে ঢাকা শহরের ২০ শতাংশ ‘পরিকল্পিত’ এলাকায় সুউচ্চ ভবন নির্মাণের ব্যবস্থা হয়েছে। অথচ অবশিষ্ট ৮০ শতাংশ এলাকাকে ‘অপরিকল্পিত’ ট্যাগ দিয়ে ভবনের উচ্চতা ও আয়তন কমিয়ে দেয়া হয়েছে। একই পরিমাণ জমিতে আগে যেখানে ১০ তলা ভবন ও যে আয়তন পাওয়া যেত এখন সেখানে পাঁচ তলা ও অর্ধেক আয়তন পাওয়া যাচ্ছে। এতে ভূমিমালিকরা ব্যাপক ক্ষতি ও বৈষম্যের সম্মুুখীন, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

ইমারত বিধি ২০০৮ পুনর্বহালের প্রসঙ্গ

ড্যাপকে ইতোমধ্যে ‘মরণফাঁদ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে জাতীয় গণমাধ্যমে। অথচ রাজউকের সে দিকে কোনো হুঁশ নেই- চোখ থাকতেও যেন রাজউক অন্ধ, মূক ও বধির। ড্যাপ রিভিউ কমিটির সাত উপদেষ্টার সভায় সংশোধনী চূড়ান্ত হওয়ার কথা। বিতর্কিত ড্যাপে ভবনের জন্য ক্ষেত্রফল পাওয়া যেত ভূমির প্রায় অর্ধেক ৫০ শতাংশ। সে জায়গায় সংশোধনীতেও নাকি মাত্র ৬০ শতাংশ পাওয়া যাবে! ভুক্তভোগী ক্ষতিগ্রস্ত জমিমালিকদের পক্ষে তাই আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে, এতেও সেই আগের মতোই ভূমিমালিকসহ অন্যরা একই ক্ষতির মুখে পড়বেন।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, রাজউক অনড় দৃষ্টিভঙ্গি, ইগো এবং কষ্টকল্পিত জটিলতায় একাধিকবার সংশোধনীর ঘোষণা দিয়েও নেতিবাচক অবস্থান পাল্টাচ্ছে না। ওয়াকিবহাল মহলের প্রশ্ন- রাজউক এই অনড় ও রক্ষণশীল মনোভাব দিয়ে কিভাবে সংশোধনীর প্রথম অধ্যায়ে ঘোষণা অনুযায়ী ‘সহজ ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নাগরিকসেবা প্রদান’ করবে? তাই ড্যাপের নানাবিধ বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন অংশীজন এই পরস্পরবিরোধী ও দ্বিমুখী নীতি পরিমার্জনসহ সমন্বয় সাপেক্ষে মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ পুনর্বহালের কথা তুলছেন।

রিহ্যাবের সভাপতি মো: ওয়াহিদুজ্জামান ২০২৪-এর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বলেছিলেন, বাংলাদেশে জমির তুলনায় জনসংখ্যা বেশি। তাই আমাদের অবশ্যই ভবন উপরের দিকে তুলতে হবে। নির্মাণ খাতের সাথে অর্থনীতির সম্পর্ক নিবিড়। জিডিপিতে ১৫ শতাংশ অবদান রাখা নির্মাণ লিংকেজসহ আবাসনশিল্প খাতের দুরবস্থার চিত্রও তুলে ধরেন তিনি।

মূল অগ্রাধিকার : জনস্বার্থ না পরিবেশ!

পরিকল্পনাবিদদের সংস্থা আইপিডি ও বিআইপির যুক্তির মূলে থাকে পশ্চিমা উন্নত দেশের নগরায়নের ভূত আর পরিবেশ ব্যাহত হওয়ার কথিত কষ্টকল্পনা! পাশ্চাত্য নগরায়নের কল্পনাবিলাসে এরা ভুলে থাকেন ঢাকা আর নিউ ইয়র্ক-লন্ডন-প্যারিসের দূরতিক্রম্য আর্থসামাজিক পার্থক্য ও অবকাঠামো উন্নয়নের আকাশ-পাতাল ব্যবধান চিত্র। বলা বাহুল্য, নগর পরিকল্পনায় এ যাবৎ যত সিদ্ধান্ত গৃহীত ও কার্যকর হয়েছে সেসবের প্রায় বেশির ভাগই উচ্চবিত্ত, সরকারি আমলা ও নীতিনির্ধারকদের স্বার্থে প্রণীত। ড্যাপে ভবনের উচ্চতা ও দৈর্ঘ্য হ্রাসের পরিকল্পনায়ও সেই একই মানসিকতা দৃশ্যমান। ফলে এতে জনদুর্ভোগ আরো বেড়েছে। সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়েছে ব্যাপকভাবে। বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের (আইএবি) সভাপতি খন্দকার সাব্বির আহমেদ ২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ঢাকা শহরের ৬৬ শতাংশ এলাকা রাজউক পরিকল্পনার বাইরে। এই ৬৬ শতাংশের জন্য ড্যাপে সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত না করে এসব এলাকাকে দমিয়ে রাখা হয়েছে। আইএবি সহসভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মাদ আলী নকী জানান, ড্যাপে বিদ্যমান বৈষম্য ও ক্ষেত্রবিশেষে অস্পষ্টতার কারণে নতুন ভবনের নকশা অনুমোদনের প্রক্রিয়া চলার সময়ে রাজউকের অসাধু চক্রের দৌরাত্ম্য মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বেড়েছে সময়ক্ষেপণ, বিভ্রান্তি ও দুর্নীতি এবং সর্বোপরি ভূমির মালিক তথা জনসাধারণের অযাচিত হয়রানি। তিনি এমন অবস্থায় এই ড্যাপ বাস্তবায়ন স্থগিত করে এর আইনি ও অন্যান্য অসঙ্গতি দূর করার জন্য সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিতে অবিলম্বে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। ড্যাপে প্রত্যক্ষ ক্ষতির শিকার বহু কষ্টের টাকায় কেনা চার-পাঁচ-সাত কাঠার জমিতে বাড়ি করার স্বপ্ন দেখা সাধারণ, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষগুলো। যদিও এই মানুষগুলোর মনোবেদনা ও স্বার্থের কথা- নীতিনির্ধারকদের বিবেচনায় খুব একটা প্রতিফলিত হয় না। ড্যাপবিষয়ক নীতিনির্ধারণে মূল অংশীজন হিসেবে বাড়ির স্বপ্ন দেখা জমিমালিকদেরই অগ্রাধিকার দিতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক, কবি [email protected]