মালয়েশিয়ায় লোক পাঠিয়ে ১১২৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ

লোটাস কামাল, নিজাম হাজারী ও মাসুদ উদ্দিনসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক
Printed Edition
Dudok

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত অর্থের অতিরিক্ত এক হাজার ১২৮ কোটি ৬১ লাখ ৫০ হাজার টাকা আদায় ও বিদেশে পাচারের অভিযোগে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও তার পরিবার, সাবেক সংসদসদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব:) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী এবং সাবেক সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদের প্রতিষ্ঠানসহ ১২টি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলায় মোট ৩৩ জনকে আসামি করা হয়েছে।

গতকাল দুদকের মহাপরিচালক মো: আক্তার হোসেন মামলা দায়েরের বিষয় জানিয়ে বলেন, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ও অসৎ উদ্দেশ্যে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাবেক মন্ত্রী, এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর হিসেবে, বায়রার বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালনকালে সিন্ডিকেট করে বিএমইটি ও বায়রার রেজিস্ট্রেশনের শর্ত ভঙ্গ করে সরকার নির্ধারিত ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকার চেয়ে ৫ গুণ অতিরিক্ত টাকা গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, অভিযুক্তরা চুক্তিবদ্ধ আইনসঙ্গত পারিশ্রমিক ব্যতীত এবং চুক্তির শর্ত মোতাবেক কাজ না করে পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে অবৈধ পারিতোষিক গ্রহণ করে মালয়েশিয়ায় প্রেরিত কর্মীর কাছ থেকে পাসপোর্ট, স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং প্রতি কর্মীর কাছ থেকে নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করে আত্মসাৎ করেছেন। তারা অবৈধভাবে গৃহীত অর্থ অবৈধ পন্থায় হস্তান্তর, স্থানান্তর, রূপান্তরের মাধ্যমে অর্থ পাচার করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

দুদক জানায়, ১২টি রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্যে মেসার্স ওরবিটাল এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে ৬ হাজার ২৯ প্রবাসীর কাছ থেকে অতিরিক্ত ১০০ কোটি ৯৮ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ টাকা নেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রী কাশমিরি কামাল। মামলায় কাশমিরির পাশাপাশি তার স্বামী মুস্তফা কামালও আসামি।

মেসার্স ওরবিটাল ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে ২ হাজার ৯৯৫ জন থেকে অতিরিক্ত ৫০ কোটি ১৬ লাখ ৬২ হাজার টাকা গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক মুস্তফা কামালের মেয়ে নাফিসা কামাল। এ মামলায় বাবা-মেয়ে দুজনই আসামি।

স্নিগ্ধা ওভারসিজ লিমিটেডের মাধ্যমে ৬ হাজার ৬৫৭ জন প্রবাসীর কাছ থেকে অতিরিক্ত ১১১ কোটি ৫০ লাখ ৪৭ হাজার ৫০০ টাকা গ্রহণের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির মালিক সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী, তার স্ত্রী নুরজাহান বেগম, শেখ আব্দুল্লাহ, জাহাঙ্গীর আলম, এম আমিরুল ইসলাম, জসিম উদ্দিন ও মো: জিয়াউর রহমান ভূঁইয়া।

রিক্রুটিং এজেন্সি বিনিময় ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে ৫ হাজার ৪৫৮ জন থেকে অতিরিক্ত ৯১ কোটি ৪২ লাখ ১৫ হাজার টাকা গ্রহণের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির মালিক চৌদ্দগ্রামের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুস সোবহান ভূঁইয়া, তার স্ত্রী তাসলিমা আক্তারকে আসামি করা হয়েছে।

ফাইভএম ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে ৭ হাজার ১২৪ জন প্রবাসী থেকে অতিরিক্ত ১১৯ কোটি ৩২ লাখ ৭০ হাজার টাকা গ্রহণের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির মালিক ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, নূর মোহাম্মদ আব্দুল মুকিত, মেহবুবা আফতাব সাথি, মাসুদ উদ্দিনের মেয়ে তাসনিয়া মাসুদ আসামি।

মেসার্স ইউনিক ইস্টার্ন প্রাইভেট লিমিটেডের মাধ্যমে ৩ হাজার ৭৮৮ জন থেকে ৬৩ কোটি ৪৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা গ্রহণের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির মালিক মোহা: নুর আলী, তার স্ত্রী সেলিনা আলী, মেয়ে নাবিলা আলী, নাছির উদ্দিন আহমেদ, সাবেক সচিব খোন্দকার শওকত হোসেনকে আসামি করা হয়েছে।

ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের মাধ্যমে ৭ হাজার ৭৮৭ জন থেকে ১৩০ কোটি ৪৩ লাখ ২২ হাজার ৫০০ টাকা অতিরিক্ত গ্রহণের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির মালিক মোহাম্মদ রুহুল আমিন এবং তার স্ত্রী লুৎফুর নেছা শেলী আসামি।

মেসার্স আহমদ ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে ৮ হাজার ৫৯২ জন প্রবাসীর কাছ থেকে ১৪৩ কোটি ৯১ লাখ ৬০ হাজার টাকা অতিরিক্ত গ্রহণের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির মালিক ঢাকা-২০ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বেনজীর আহমদকে আসামি করা হয়েছে।

বি এম ট্রাভেলস লিমিটেডের মাধ্যমে ৮ হাজার ৯৩ জন প্রবাসীর কাছ থেকে ১৩৫ কোটি ৫৫ লাখ ৭৭ হাজার ৫০০ টাকা অতিরিক্ত গ্রহণের অভিযোগে আসামি হয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির মালিক ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর মো: শফিকুল ইসলাম এবং তার স্ত্রী মৌসুমি আক্তার।

বিএনএস ওভারসিজ লিমিটেডের মাধ্যমে ৪ হাজার ২১৫ জন প্রবাসী থেকে ৭০ কোটি ৬০ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা গ্রহণের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির মালিক যুবলীগ নেতা ইশতিয়াক আহমেদ সৈকত ও তার স্ত্রী নসরুন নেছাকে আসামি করা হয়েছে।

অন্য দিকে রুবেল বাংলাদেশ লিমিটেডের মাধ্যমে ২ হাজার ৮৪৫ জন থেকে ৪৭ কোটি ৬৫ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা গ্রহণের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির মালিক মুহাম্মদ মজিবুল হক রুবেল ও তার স্ত্রী কামরুন নাহার হীরামনি আসামি হয়েছেন।

এ ছাড়া দ্য ইফতী ওভারসিজের মাধ্যমে ৩ হাজার ৭৯৭ জন প্রবাসী থেকে অতিরিক্ত ৬৩ কোটি ৫৯ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০ টাকা গ্রহণের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির মালিক মো: রুবেল ও বোরহান উদ্দিন পান্নাকে আসামি করা হয়েছে।

দুদকের অনুসন্ধানে মালয়েশিয়াগামী প্রত্যেক শ্রমিকের কাছ থেকে অতিরিক্ত ১ লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ টাকা নেয়া হয়েছে ধরে হিসাব করা হয়। সরকার নির্ধারিত অতিরিক্ত ফি বাবদ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে শুরু হয় দুদকের অনুসন্ধান।