আত্মশুদ্ধি ও আত্মোপলব্ধির সোপান সিয়াম
Printed Edition
আল্লাহ মানুষকে বিবেক-বুদ্ধি ও ভালো-মন্দ জ্ঞানসহ সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের হেফাজতের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে ফেরেশতারা পাহারায় নিযুক্ত থাকে। তাঁর প্রিয় বান্দাহ বিপথগামী হয়ে তাঁর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হোক এটি তিনি চান না। এতদসত্ত্বেও কেউ সঠিক ও কল্যাণের পরিবর্তে মন্দ ও অভিশপ্ত পথ নির্বাচন এবং তাতে অনড় থাকলে; আল্লাহর নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও তাঁর আনুগত্য ত্যাগ করে কুকর্ম, কুচরিত্র ও অবাধ্যতার পথ বেছে নিলে তার পরিণতি হয় দুঃখজনক। যে গজব নেমে আসে তা থেকে আত্মরক্ষার কোনো উপায় থাকে না। কোনো ব্যক্তি বা জাতির জীবনে কল্যাণকর পরিবর্তন ততক্ষণ পর্যন্ত সূচিত হয় না, যতক্ষণ এই কল্যাণকর পরিবর্তনের জন্য নিজেদের অবস্থা সংশোধন করে নিজেদেরকে তার যোগ্য করে না তোলা হয়। মাহে রমজানে সিয়াম সাধনায় পার্থিব জীবনযাপনের নিত্যতা ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এক অমোঘ মূল্যবোধ জাগ্রত হয়
সিয়াম সাধনায় আত্মশুদ্ধির চেতনা জাগ্রত হয়। কর্মফলের দ্বারা আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতের স্থায়িত্বের হ্রাস-বৃদ্ধি প্রসঙ্গে আল কুরআনের সুস্পষ্ট ঘোষণা অনুধাবন ও উপলব্ধির মধ্যে আত্মশুদ্ধির চিন্তাচেতনা পরিশীলিত হতে পারে। সূরা আনফালের ৫৩ নম্বর আয়াতে ঘোষিত হয়েছে, ‘যদি কোনো সম্প্রদায় নিজের অবস্থার পরিবর্তন না করে তবে আল্লাহ এমন নন যে, তিনি তাদেরকে যে সম্পদ দান করেন তিনি তা পরিবর্তন করবেন এবং আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ সূরা আর রা’দের ১১ নম্বর আয়াতে আরো স্পষ্টভাবে ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষের জন্য তার সম্মুখে ও পশ্চাতে একের পর এক প্রহরী থাকে; তারা আল্লাহর আদেশে তার রক্ষণাবেক্ষণ করে এবং আল্লাহ কোনো সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে। কোনো সম্প্রদায়ের সম্পর্কে যদি আল্লাহ অশুভ কিছু ইচ্ছা করেন তবে তা রদ করার কেউ নেই এবং তিনি ব্যতীত তাদের কোনো অভিভাবক নেই।’
আল্লাহর নিয়ামত স্থায়িত্বের যে নিয়ম বা মূলনীতি তা হলো কোনো ব্যক্তি বা জাতিকে যে নিয়ামত দান করা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তা ফিরিয়ে নেয়া হয় না, যে পর্যন্ত না নিজের বা নিজেদের অবস্থা ও কার্যকলাপ পরিবর্তন করে আল্লাহর আজাবকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এখানে অবস্থা পরিবর্তনের অর্থ হলো ভালো ও সৎ অবস্থা বা কর্মের পরিবর্তে মন্দ অবস্থা ও কার্যকলাপ অবলম্বন করা কিংবা আল্লাহ তায়ালার নিয়ামত আগমনের সময় যেসব মন্দ ও পাপকাজে লিপ্ত ছিল নিয়ামতপ্রাপ্তির পর তার অধিক মন্দকাজে লিপ্ত হওয়া। নিয়ামতপ্রাপ্তির পর তার জন্য শুকরিয়া আদায় করা, সচেতন দায়িত্ব পালনের দ্বারা এর মর্যাদা রক্ষা করা এবং নিজেদের মধ্যে সংশোধনীয় বিষয়গুলোর ব্যাপারে সচেতন হওয়া বাঞ্ছনীয়।
অনেক সময় আল্লাহ তায়ালা তাঁর নিয়ামত এমন কোনো লোক বা সম্প্রদায়কে দান করেন, যে তার নিজের বা নিজেদের আমল বা কর্মের দ্বারা তার যোগ্য নয়, কিন্তু প্রদত্ত হওয়ার পর যদি সে নিজের আমল বা কর্মধারা সংশোধন করে কল্যাণের দিকে ফেরানোর পরিবর্তে মন্দ কাজের দিকে আরো বেশি উৎসাহী হয়ে পড়ে, তখন প্রদত্ত নিয়ামত তার বা তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়।
আল্লাহ মানুষকে বিবেক-বুদ্ধি ও ভালো-মন্দ জ্ঞানসহ সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের হেফাজতের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে ফেরেশতারা পাহারায় নিযুক্ত থাকে। তাঁর প্রিয় বান্দাহ বিপথগামী হয়ে তাঁর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হোক এটি তিনি চান না। এতদসত্ত্বেও কেউ সঠিক ও কল্যাণের পরিবর্তে মন্দ ও অভিশপ্ত পথ নির্বাচন এবং তাতে অনড় থাকলে; আল্লাহর নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও তাঁর আনুগত্য ত্যাগ করে কুকর্ম, কুচরিত্র ও অবাধ্যতার পথ বেছে নিলে তার পরিণতি হয় দুঃখজনক। যে গজব নেমে আসে তা থেকে আত্মরক্ষার কোনো উপায় থাকে না। কোনো ব্যক্তি বা জাতির জীবনে কল্যাণকর পরিবর্তন ততক্ষণ পর্যন্ত সূচিত হয় না, যতক্ষণ এই কল্যাণকর পরিবর্তনের জন্য নিজেদের অবস্থা সংশোধন করে নিজেদেরকে তার যোগ্য করে না তোলা হয়।
মাহে রমজানে সিয়াম সাধনায় পার্থিব জীবনযাপনের নিত্যতা ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এক অমোঘ মূল্যবোধ জাগ্রত হয়। ধন সম্পদের প্রাচুর্যে ভরা আরাম আয়েশ উল্লাস ঐশ্বর্যময় জীবনযাপনে চিরন্তন শান্তি নেই। ভোগে নয়, ত্যাগেই মুক্তি। এই উপলব্ধিরও বিকল্প নেই যে, কৃচ্ছ্রতা সাধনের মধ্যে রয়েছে স্থায়ী পরিতৃপ্তি ও কল্যাণের নিশ্চয়তা। কুরআনুল করিমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের নিকট যা আছে তা নিঃশেষ হবে এবং আল্লাহর নিকট যা আছে তা স্থায়ী। যারা ধৈর্য ধারণ করে আমি নিশ্চয়ই তাদের তারা যা করে তা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব। মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকর্ম সম্পাদন করবে তাকে আমি নিশ্চয়ই আনন্দময় জীবন দান করব এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব।’ (সূরা আন-নাহল : ৯৬- ৯৭)
‘তোমাদের নিকট যা আছে’ তাফসিরকারকদের মতে, এর মধ্যে পার্থিব ধন সম্পদ অন্তর্ভুক্ত তো আছেই, এ ছাড়া দুনিয়াতে মানুষ আনন্দ-বিষাদ, সুখ-দুঃখ, সুস্থতা-অসুস্থতা, লাভ-লোকসান, বন্ধু-শত্রুতা ইত্যাদি যেসব অবস্থার সম্মুখীন হয়, সবই এর মধ্যে পড়ে। বাস্তবিক বিচারে এগুলো সবই ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু এসব অবস্থা ও ব্যাপারের প্রতিক্রিয়া, যার কারণে শেষবিচারের দিনে সওয়াব কিংবা শাস্তি সাব্যস্ত হবে তার হিসেবে সংরক্ষিত থাকবে। সুতরাং পার্থিব ধনসম্পদ এবং এসব ধ্বংসশীল ও অস্থায়ী অবস্থা ও কাজ কারবারে মগ্ন থাকা এবং জীবন ও জীবনের কর্মক্ষমতা এ ব্যাপারে নিয়োজিত করা বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। যে সম্পদ ও বিষয়াবলি ক্ষণস্থায়ী এবং যার স্থায়িত্বের ও ভূমিকার ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ নেই বা থাকবে না তা অর্জনে অবৈধ পন্থা অবলম্বনের দ্বারা পাপাচারে লিপ্ত হওয়া এবং ফলশ্রুতিতে ইহ ও পরকালে শাস্তি ভোগের সম্মুখীন হওয়ার মধ্যে যুক্তি নেই। জাগতিক সুনাম কিংবা সন্তানসন্ততির ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে অনেকে অন্ধভাবে সম্পদ অর্জনে আত্মহারা হয়ে যায়। ক্ষণস্থায়িত্ব ও নিরাপত্তা বিধানে নিজের সক্ষমতায় সীমাবদ্ধতা থাকায় এবং নিজের অবর্তমানে সন্তানসন্ততি কিভাবে এই সহায় সম্পত্তি ভোগ করবে সে ব্যাপারেও নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় অন্ধভাবে সম্পদ অর্জনে নিজের আত্মাকে কলুষিত করার বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বনের তাগিদ রয়েছে এ আয়াতে।
পরবর্তী আয়াতে আনন্দময় জীবন বা ‘হায়াতে তাইয়্যেবা’ বলতে দুনিয়ার পবিত্র ও আনন্দময় জীবন বোঝানো হয়েছে। এই পবিত্র ও আনন্দময় জীবনের অর্থ আবার এই নয় যে, সে জীবনে মুমিন ব্যক্তি কখনো অনাহার উপবাস ও অসুখ বিসুখের বিপদাপদের সম্মুখীন হবে না। ব্যাখ্যা এই যে মুমিন ব্যক্তি কোনো সময় আর্থিক অভাব-অনটন কিংবা কষ্টের সম্মুখীন হলেও দু’টি বিষয় তাকে উদ্বিগ্ন হতে দেয় না : ১. অল্পতুষ্টি এবং অনাড়ম্বর জীবনযাপনের অভ্যাস, যা দারিদ্র্যের মধ্যেও কেটে যায়; ২. এটি এই বিশ্বাসে যে, এই অভাব-অনটন ও অসুস্থতা, দুর্বিপাক ও দুর্ঘটনার বিষয়গুলো ক্ষণস্থায়ী এবং এর বিনিময়ে পরকালে সুমহান ও চিরস্থায়ী নিয়ামত পাওয়া যাবে। দুনিয়ার মোহে আচ্ছন্ন কাফের ও পাপাচারীর অবস্থা এর বিপরীত। সে অভাব অনটন, অসুস্থতা ও বিপদাপদের সম্মুখীন হলে তার জন্য সান্তনার কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে সে নিরতিশয় উদ্বিগ্ন হয়ে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলে। প্রায়ই আত্মহত্যা করে। পক্ষান্তরে সে যদি সচ্ছল জীবনের অধিকারী হয় তবে লোভের আতিশয্য তাকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। সে কোটিপতি হয়ে গেলে অর্বপতি বা বিলিয়নিয়ার হওয়ার চিন্তায় জীবনকে বিড়ম্বনাময় করে তোলে।
মাহে রমজানে কুরআন চর্চা সিয়াম সাধনায় সূচিত হতে পারে আত্মোপলব্ধি ও আত্মশুদ্ধির উপায়। আল কুরআনের সূরা আল ফোরকানের ৬৩ থেকে ৭৭ নং আয়াতসমূহে আল্লাহর বিশেষ ও প্রিয় বান্দাহদের ১৩টি গুণ ও আলামত বর্ণিত হয়েছে। প্রথম ছয়টি গুণাবলির মধ্যে আনুগত্যের মূলনীতি এবং পরবর্তী গুণাবলিসমূহ গোনাহ ও অবাধ্যতা থেকে পরিত্রাণ প্রত্যাশার/প্রচেষ্টার নীতিমালা বর্ণিত হয়েছে। ১৩টি গুণাবলি হলো :
১. নিজের বিশ্বাস, চিন্তাচেতনা, ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষা, আচার-আচরণ ও স্থিরতাকে পালনকর্তার আদেশ ও অভিপ্রায়ের অনুগামী রেখে তাঁর আদেশ-নিষেধ পালনের জন্য সদা উৎসুক থাকা।
২. নম্রভাবে চলাফেরা করা, চলন-বলন, আচার-আচরণে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা। গর্বিত অহঙ্কারীর মতো পা না ফেলা। আবার ইচ্ছাকৃতভাবে রোগীদের মতো অতি ধীরেও না চলা। যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে না এবং সর্বদাই দুনিয়ার লাভ-লোকসানের ব্যাপারে উদ্বিগ থাকে, সে সর্বদা দুঃখই ভোগ করে।
৩. কথাবার্তায় সবসময় সচেতন থাকা। সালামের জবাব দেয়া, কারো মনে আঘাত লাগতে পারে, বিরূপ ভাব ও সংক্ষোভের উদ্রেক করতে পারে এমন সংলাপ পরিহার করা। সুবচন ও সুশীল আচরণ কখনোই বিতণ্ডার জন্ম দেয় না।
৪. ইবাদতে রাত জাগরণ। যে সময় নিদ্রা ও বিশ্রামের সে সময়ে কষ্টকর হওয়া সত্ত্বেও নামাজে দাঁড়ানোর মতো উত্তম কিছুই নেই। তা লোকদেখানোর জন্য নয় এবং নাম যশের আশঙ্কা এখানে নেই। হজরত ইবনে আব্বাস রা: বলেছেন, যে ব্যক্তি এশার পর দুই বা ততোধিক রাকাত নামাজ পড়ে নেয়, সে হবে তাহাজ্জুদের ফজিলতের অধিকারী।
৫. দিবা-রাতে ইবাদতে মশগুল হয়েও নিশ্চিন্ত হয়ে বসে না থাকা। আল্লাহকে ভয় করা, জীবিকা অন্বেষণ ও তার সাহায্য কামনা করা।
৬. ব্যয় করার সময় অপব্যয় না করা, কৃপণতা ও ত্রুটি না করে আয়-ব্যয়ের মধ্যে সমতা বজায় রাখা। বৈধ ও অনুমোদিত কাজে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয় করাও অপব্যয়ের অন্তর্ভুক্ত। রাসূলে করিম সা: বলেছেন, ব্যয় করতে গিয়ে মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন করা মানুষের বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। যে ব্যক্তি ব্যয়ের সময় মধ্যবর্তিতা ও সমতার ওপর কায়েম থাকে, সে কখনো ফকির ও অভাবগ্রস্ত হয় না।
৭. শিরক সর্ববৃহৎ গোনাহ। দুনিয়ার ভালোমন্দে কাউকে নিয়ন্ত্রক ভাবাও শিরক।
৮. কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা না করা এবং ব্যভিচারের নিকটবর্তী না হওয়া।
৯. তওবা করা। কঠোর অপরাধী যদি তওবা করে এবং বিশ্বাস স্থাপন করে সৎকর্ম করতে থাকে, তবে আল্লাহ তার মন্দ কর্মসমূহকে পুণ্য দিয়ে পরিবর্তন করে দেবেন।
১০. মিথ্যা ও বাতিল মজলিসে যোগ না দেয়া, মিথ্যা সাক্ষ্য না দেয়া।
১১. যদি কেউ মিথ্যা ও বাতিল মজলিসের নিকটবর্তী হয়ে পড়ে তবে গাম্ভীর্য ও ভদ্রতাসহকারে তা এড়িয়ে বা পরিহার করে চলে যাওয়া উচিত।
১২. আল্লাহর আয়াত ও শরিয়তের বিধানাবলি শুধু পাঠ করা যথেষ্ট নয়, শ্রবণশক্তি ও অনুদৃষ্টি-সম্পন্ন মানুষের উচিত এগুলো সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা এবং তদনুযায়ী আমল করা।
১৩. নিজ সন্তানসন্ততি ও স্ত্রীর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা। তাদের আল্লাহর আনুগত্যে মশগুল দেখা।
লেখক : সাবেক সচিব,
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান