আওয়ামী সংস্কৃতি আমাদের নয়

বাংলাদেশে এখন একটি নিরঙ্কুশ গণতন্ত্রের পরিবেশ রয়েছে। এই সময়কে অবাধ স্বাধীনতার সুযোগ বলে মনে করা যায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে লেইসেস ফেয়ার বা অবাধ স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারেরই নামান্তর। মনীষী রুশো বলছেন ‘Man is Born Free But Every Where he is in Chains’ নিয়ম-কানুন, শৃঙ্খলা, ভদ্রতা, সৌজন্য, সভ্যতা দ্বারা পরিত্যক্ত আওয়ামী সংস্কৃতির জবাব দিতে হবে। আমাদের সীমাবদ্ধতা যাই হোক না কেন, আওয়ামী রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে সুদৃঢ়ভাবে না বলুন

ড. আবদুল লতিফ মাসুম

বাংলা ভাষায় সংস্কৃতি শব্দটির ব্যবহার বেশি দিনের নয়। ইংরেজি Culture-এর প্রতিশব্দ হিসেবে সংস্কৃতি শব্দটি ১৯২২ সালে বাংলায় প্রথম ব্যবহার শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য কৃষ্টি শব্দটিকে শ্রেয় মনে করতেন। কৃষিপ্রধান বাংলার সাথে কৃষ্টি শব্দটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে করতেন তিনি। সংস্কৃতি বা কৃষ্টি যে নামেই ডাকা হোক মূল কথাটি হলো যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি। আরেকটু একাডেমিকভাবে বললে বলা যায় সংস্কৃতি (Culture) হলো এমন একটি ধারণা, যা মানব সমাজের সামাজিক আচরণ, প্রতিষ্ঠান ও নিয়ম-কানুনকে অন্তর্ভুক্ত করে। এটি একই সাথে সমাজের মানুষের জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্প, আইন, রীতি-নীতি, দক্ষতা, মনোভাব ও অভ্যাসের প্রতিফলনও ঘটায়। সাধারণত, সংস্কৃতি কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল বা স্থানের সাথে সম্পর্কিত বা সেখান থেকে বিকাশ লাভ করে। সাংস্কৃতিক নিয়ম সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য আচরণের একটি কাঠামো নির্ধারণ করে। এটি কোনো নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে মানুষের পোশাক, ভাষা, আচরণ ও সামাজিকতা কেমন হবে, তা নির্দেশ করে। কোনো সমাজে একমাত্রিক সংস্কৃতি গ্রহণ করা কাম্য নয়। সংস্কৃতি সতত, সাধারণ ও স্বাভাবিক। কিন্তু যখন একমাত্রিক সংস্কৃতির রাজনৈতিক প্রয়োগ ঘটে তখনই মানুষের বিপরীতে নির্দেশিত বা আরোপিত সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষ করা যায়। ঠিক এমনটিই ঘটেছিল বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে। এ দেশের মাটি ও মানুষের কথাবার্তা, চাল-চলন, আচার-আচরণ, অনুভূতি-উপলব্ধি ও সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থার বিপরীতে নির্দেশিত ও আরোপিত সংস্কৃতি যখন ক্ষমতার জোরে প্রায়োগিক হয়ে ওঠে, তখন সমাজে স্বাভাবিকভাবেই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটে। এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অভিঘাতে উড়ে যেতে পারে কারো ময়ূর সিংহাসন। ২০২৪ সালের গণআন্দোলন বা গণবিপ্লবে ঠিক এমনটিই ঘটেছিল। সামগ্রিকভাবে বিরূপ সংস্কৃতির আকার-প্রকার ও বিষয়-বৈশিষ্ট্য ভিন্নতর গবেষণা ও গ্রন্থনার প্রয়োজন। আজকে আমরা শুধু সংস্কৃতির রাজনৈতিক অংশ নিয়ে তাৎক্ষণিক আলোচনা করব। বলে রাখা ভালো, সংস্কৃতি আর রাজনৈতিক সংস্কৃতি উৎসগতভাবে এক হলেও ব্যবহারিকভাবে ভিন্নতর। সংস্কৃতির সাথে রাজনৈতিক সংস্কৃতি একটি নবতর পরিভাষা। রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে ষাটের দশকে পশ্চিমা বিশ্বে যে বিপুল সংযোজন ঘটে, এই পরিভাষাটি তারই ফল। ইতঃপূর্বে প্রচলিত কয়েকটি ভাবাদর্শকে সমন্বিত করার প্রয়াস এতে রয়েছে। রাজনৈতিক আদর্শ , জাতীয় বৈশিষ্ট্য (ঘধঃরড়হধষ ঊঃযড়ং), জাতীয় চেতনা ও মনোস্তত্ত্ব, জনগণের মৌলিক মূল্যবোধ এবং জনমত দ্বারা যেসব বিষয়ের অবতারণ করা হতো, ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি’ পরিভাষাটি সে সব বিষয়ের সামগ্রিক পরিচয় বহন করে। আমাদের আজকের আলোচনাটি বাংলাদেশের বহমান রাজনীতিকেন্দ্রিক। এখানে ব্যক্তি ও সমষ্টির আচার-আচরণ, মনোস্তাত্ত্বিক গড়ন ও সমাজতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যকে আপাতভাবে বোঝার চেষ্টা রয়েছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি কেতাবি সংজ্ঞা দেয়া যাক। Social Science Encyclopedia অনুযায়ী রাজনৈতিক সংস্কৃতি হচ্ছে : ‘ÔThe set attitudes, beliefs and sentiments which give order and meaning to a political process and which provide the understanding assumptions and rules that govern behavior in the political system.Õ (L.W. Pye : 1962 : 218). একক রাজনৈতিক সংস্কৃতি বহুমাত্রিক সমাজ গঠনের পরিপন্থী। গণতান্ত্রিক তথা পুঁজিবাদী সমাজে ‘শত ফুল ফুটতে দেয়া হয়’। অপর দিকে, সমাজতান্ত্রিক তথা মার্কসবাদী দর্শনে বৈপরিত্যের সংস্কৃতি সহ্য করা হয় না। তৃতীয় বিশ্বের তথাকথিত ব্যক্তিবাদ তথা সম্মোহনী নেতৃত্ব (Charismatic Leadership) নির্ভর রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। নাসেরবাদ, গাদ্দাফিবাদ, টিটুবাদ ও অবশেষে মুজিববাদের মতো ধারণা এককবাদের প্রাতিষ্ঠানিকতা দান করে। বাংলাদেশের আওয়ামী সংস্কৃতিতে মুজিববাদের প্রভুত্ব রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। বিগত ১৫ বছরে মুজিববাদের অপভ্রংশ হিসেবে হাসিনাবাদ (Hasinocrasy) রাজনৈতিক সংস্কৃতির নির্ধারক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন গণতন্ত্রের বদলে উন্নয়নের গণতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। যখনই গণতন্ত্রের সাথে এরকম বিশেষণ জুড়ে দেয়া হয়, তখন মনে করতে হবে ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’। এভাবে পাকিস্তানের লৌহমানব আইয়ুব খান মানুষকে আদি আসল ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ উপহার দিতে চেয়েছেন। মিসরের জামাল আব্দুল নাসের Controlled Democracy-এর কথা বলেছেন। ইন্দোনেশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা সুকার্নো Guided Democracy প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। সমাজবাদীরা শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে। এসব কিছু গণতন্ত্র ভিন্ন অন্য কিছু। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ বলেছে ‘শেখ হাসিনার মূলমন্ত্র-উন্নয়নে গণতন্ত্র’। স্পষ্টতই তারা উন্নয়নের নামে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে। তারা অর্থনীতিকে লুটপাটতন্ত্রে পরিণত করেছে। জাতীয় সংস্কৃতিকে বিজাতীয় সংস্কৃতি প্রতিস্থাপনের অপচেষ্টা করেছে। ড. বদরুদ্দিন ওমরের ভাষায় শুধুই যে হাসিনা রাজনৈতিকভাবে কৃতদাসী হয়েছে তাই নয়, শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারতমুখী রাষ্ট্রীয় আদর্শ নির্মাণের চেষ্টা করেছে। ভারত থেকে আমদানিকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সহায়তার অন্যতম শর্ত ছিল বলে জানা যায়। ২০২৩ সালে যে পাঠ্যপুস্তকে বিতর্ক দেখা দেয় সেখানে মোদি আদর্শ প্রতিফলিত হয়। ওরা বলে মুসলমানরা ভারতে বহিরাগত। বাংলাদেশ জাতি রাষ্ট্রের যে মৌলিক পরিবর্তন জিয়াউর রহমান সংবিধানে এনেছিলেন তা পরিত্যাগ করে ধর্মনিরপেক্ষতা আবার প্রতিস্থাপিত হয়। সমাজতন্ত্র দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেও এখানে তার পুনরুজ্জীবন ঘটে। এ দেশের শিক্ষা-স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলো একের পর এক ধ্বংস করে ভারতকে কেবলা বানানো হয়। মূলত বাংলাদেশের বাংলা ভাষার ঢাকাকেন্দ্রিক রাজধানীর কথা আমাদের আল মাহমুদরা বলে আসছিলেন তা পরিবর্তিত হয়। কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশের ভাষা ও সাহিত্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের সিনেমা শিল্প প্রায় অচল হয়ে পড়ে। যৌথ প্রযোজনার নামে প্রতিবেশীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের চ্যানেলগুলো অকেজো করে কলকাতাকেন্দ্রিক চ্যানেলগুলো আধিপত্য লক্ষ করা যায়। সেসব চ্যানেলে সুকৌশলে জটিলতা-কুটিলতা ও হিন্দু ধর্মের গুণকীর্তন করা হয়। এতক্ষণ যা বলা হলো মূলত তা সংস্কৃতির কথা। কিভাবে একটি জাতির শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয় তার নমুনা ১৫ বছরের ঘটনাপ্রবাহে পাওয়া যায়। আর এসবগুলো ঘটে নীরবে, নিভৃতে ও সংগোপনে। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকাশ, বিকাশ ও লালন-পালন হয়েছে দৃশ্যমানভাবে। কোনোরকম রাখঢাক ছাড়াই বাঙালির সংস্কৃতি হিসেবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাসের বিপরীতে এসব কিছু আরোপিত হয়েছে। পয়লা বৈশাখ নিঃসন্দেহে আমাদের সংস্কৃতি। কিন্তু তার লালন পালন ও আনুষ্ঠানিকতা এখানে এবং ওখানে ভিন্নতর হতে বাধ্য। যে বিশ্বাসের কারণে ১৯৪৭ সালে দেয়াল উঠেছে সীমান্তে, সেটি তো ১৯৭১ সালে মুছে যায়নি। আবুল মনসুর আহমেদের ভাষায় টাওয়ার বাংলা ও খামার বাংলার পার্থক্য রয়েই গেছে। ১৯০৫ সালে বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদন হলো বলে তারা কেঁদেছে। ১৯৪৭ সালে আমরা যখন অবিভক্ত বাংলার জন্য কেঁদেছি, তখন তারা যুক্ত বাংলার কপাল ভেঙেছে। সেই বিভাজন ও বিষোদগারকে আওয়ামী লীগ সরকার মুছে দিতে চেয়েছে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আজ আওয়ামী সরকারের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলাম ও মুসলিম সংস্কৃতি বিতাড়ন তাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। মুসলিম নামগুলো বিদূরিত হয়। যেখানে যেখানে আল্লাহর কালাম ছিল, সেগুলো মুছে দেয়া হয়। মাদরাসাগুলো সরকারিভাবে অবহেলার শিকার হয়। ১৯৭২-৭৫ সময়ে একটি মাদরাসাও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৯৬ সালে সাময়িকভাবে এবং ২০০৯ সালে আওয়মী লীগ যখন স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, তখন তারা পূর্ব অনুসৃত সংস্কৃতিতে ফিরে যায়। ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের আদর্শ হলো তাদের নেতৃত্ব ও প্রভুত্ব বাদে সব কিছু অস্বীকার করা। ব্যক্তি বন্দনা প্রশস্তি ও প্রশংসাই তাদের আদর্শ। পার্লামেন্টে, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে কিংবা জনসভায় বন্দনা শুরু হতো তাদের বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে, আর শেষ হতো শেখ হাসিনাকে দিয়ে। জাতির আব্বাজানের একক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য তারা রাষ্ট্রযন্ত্রকে শতভাগ ব্যবহার করেছে। মুজিবশতবর্ষ পালনের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে। বঙ্গবন্ধুর তথাকথিত ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠা উপজেলা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। পদ্যে, গদ্যে, ভুগোল, ইতিহাসে এমন কোনো জায়গা নেই যে, তার স্তুতি গাওয়া হয়নি। তার একক প্রভুত্বের জন্য অন্য কোনো ব্যক্তিত্ব সেখানে উল্লিখিত হয়নি। এভাবে ঢাকা পড়েছে আমাদের নন্দিত নায়কদের গৌরবময় ইতিহাস। সেখানে নেই শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী। নির্লজ্জভাবে স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানকে (বীরউত্তম) পাকিস্তানি এজেন্ট বানানোর অপচেষ্টা করা হয়েছে। জাতীয় সংসদ এলাকা থেকে তার কবরকে সরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর বিপরীতে আমাদের সংস্কৃতি হচ্ছে সবাইকে গ্রহণ করা। যার যেখানে যেটুকু প্রাপ্য তা ফিরিয়ে দেয়া। আওয়ামী রাজনীতি সংস্কৃতির আরেকটি নিকৃষ্ট নমুনা হচ্ছে তৃণমূল থেকে রাজধানী পর্যন্ত পোস্টার, ফেস্টুন ও বিলবোর্ডে ছেয়ে ফেলা। বাংলাদেশের এমন কোনো গ্রাম নেই যেখানে আওয়ামী নেতা, পাতি নেতা ও নাতি নেতাদের ছবিসংবলিত পোস্টার দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগের ১৮ নম্বর ওয়ার্ড কমিটির ১৯ নম্বর সদস্য মনে করে ‘আমিই রাষ্ট্র’। সেখানে দেখা যেত যে জাতির আব্বাজান ও তৎকন্যা এবং হাসিনা-তনয় সজীব ওয়াজেদ জয়ের ছবি রয়েছে। আবার কখনো কখনো কন্যারত্ন পুতুল বিবির ছবি রয়েছে। শুধু তাই নয়, সেখানে এমপি সাহেব এবং আশপাশের পাতি নেতাদের ছবি সংযোজিত হয়েছে। এভাবে গুনে দেখলে ২০-২৫টি ছবি নজরে আসবে। এভাবেই রাজনীতির ন্যক্কারজনক ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা আওয়ামী লীগকেই মানায়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এ কথা সত্য, আমরা পূর্ব অনুসৃত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বুঝে অথবা না বুঝে অনুসরণ শুরু করি। ২০২৪ সালের গৌরবময় গণবিপ্লবের পর এরকম প্রবণতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ময়দানে কিছুটা দৃশ্যমান হয়ে উঠছে জাতীয়তবাদী দল-বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়ে। আওয়ামী আমলের মতো সর্বত্র তারেক রহমানের ছবি টানানোর হিড়িক পড়েছে, দলটির উচ্চপর্যায়ের সায় না থাকলেও এমনটি হচ্ছে। শুধু বিএনপি নয়, ছোট ছোট পার্টির বড় বড় নেতাদের পোস্টারের প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী সংস্কৃতির এই পথ আমাদের নয়, এটি জেনেও নেতাকর্মীরা প্রশস্তির প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। বাংলাদেশের বহমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী তারেক রহমানের খুশি হওয়ারই কথা। কিন্তু আমরা বিপরীত বার্তা পেলাম। গণ-অভ্যুত্থানের পরে তারেক রহমান এক বিবৃতিতে এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেন। বিএনপি ও এর অঙ্গ-সংগঠনগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ ধরনের পোস্টার, ব্যানার মুছে দিয়েছে। তার পরও তারেক রহমানের এ ধরনের পোস্টার, ব্যানার ও বিলবোর্ডের প্রাধান্য রয়েছে। আওয়ামী লীগের অনুসৃত এই প্রশস্তি প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি আমাদের নয়। আওয়ামী রাজনৈতিক সংস্কৃতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল ও নেতাকর্মীদের শত্রু গণ্য করার প্রবণতা। এখন আওয়ামী লীগ নেই। সেই শত্রুতার স্থান দখল করেছে প্রতিপক্ষ বিবেচিত রাজনৈতিক সংগঠন। ইতোমধ্যেই শিক্ষাঙ্গনে এরকম ঘটনা ঘটেছে। সারা দেশে প্রবলভাবে না হলেও ছোটখাটোভাবে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। সন্তুষ্টির বিষয় এই যে, বিএনপি নেতৃত্ব এসব বিষয়ে নেতাকর্মীদের সতর্ক করছে। নিজেদের মধ্যে এ ধরনের অযাচিত ঘটনা তা ছাত্র বা রাজনৈতিক কর্মী পর্যায়ে যেখানেই ঘটুক, ঘটতে দেয়া যাবে না। গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির প্রতিও প্রতিপক্ষের যে যেখানে শক্তিশালী, অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। এগুলো আওয়ামী আমলের নিকৃষ্ট সংস্কৃৃতি। একে অপরকে মোটেই সহ্য না করার অবাঞ্ছিত অভ্যাস। সমঝোতা ও সহিষ্ণুতাই হবে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি। এর আগে গণ-অভ্যুত্থানের পরপরই বিএনপির নামে অথবা বেনামে কিছু দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে। এ বিষয়েও বিএনপি ব্যবস্থা নিয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রায় দুই হাজার নেতাকর্মী অভিযুক্ত হয়ে শাস্তি পেয়েছে। দীর্ঘ ১৭ বছর যে নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার সব পর্যায়ের সব দলের নেতাকর্মী হয়েছে ধৈর্য, সহ্য, ভদ্রতা ও সৌজন্যের দ্বারা তার উত্তর দিতে হবে। নেতাকর্মীদের পদস্খলন পার্টির জন্য ভালো কিছু আনবে না। বাংলাদেশে এখন একটি নিরঙ্কুশ গণতন্ত্রের পরিবেশ রয়েছে। এই সময়কে অবাধ স্বাধীনতার সুযোগ বলে মনে করা যায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে লেইসেস ফেয়ার বা অবাধ স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারেরই নামান্তর। মনীষী রুশো বলছেন ‘Man is Born Free But Every Where he is in Chains’ নিয়ম-কানুন, শৃঙ্খলা, ভদ্রতা, সৌজন্য, সভ্যতা দ্বারা পরিত্যক্ত আওয়ামী সংস্কৃতির জবাব দিতে হবে। আমাদের সীমাবদ্ধতা যাই হোক না কেন, আওয়ামী রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে সুদৃঢ়ভাবে না বলুন।

লেখক : অধ্যাপক (অব:), সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]