ইহকাল-পরকালের সফলতায় রোজা
রমজানের এক মাস ইবাদত-বন্দেগি ও সংযমের মাধ্যমে মুসলমানরা নিজেদের সব ধরনের অন্যায় ও অনৈতিক কাজ থেকে দূরে রাখার যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে তা পরবর্তী ১১ মাস ধরে রাখতে পারলে তাদের পক্ষে সব ধরনের অন্যায় ও অনৈতিক কাজ পরিহারপূর্বক জীবনধারণ সম্ভব। এরূপ জীবনধারণ যারা করতে পারবেন তাদের ইহকাল ও পরকাল উভয় সফল

ইকতেদার আহমেদ
আল্লাহ তাঁর ইবাদত-বন্দেগি করার জন্য মানুষ সৃষ্টি করে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। ইবাদত দু’ধরনের। এর একটি হলো ‘হাক্কুল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর হক। আর অন্যটি ‘হাক্কুল ইবাদ’ অর্থাৎ বান্দার হক। আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত অধিকার বা কর্তব্যকে হাক্কুল্লাহ বলে। আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে অনেক ধরনের ইবাদত করি। সেগুলোর মধ্যে কিছু ইবাদত শুধু আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। যেমন সালাত (নামাজ), সাওম (রোজা), হজ ইত্যাদি। আল্লাহর হক আদায়ের আগে প্রত্যেক মানুষকে অন্তর থেকে যা বিশ্বাস করতে হবে তা হলো আল্লাহ আছেন, তিনি এক ও অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো শরিক নেই, তিনি সবকিছুর স্রষ্টা। তাঁর আদেশে পৃথিবীর সবকিছু আবার ধ্বংস হবে। আমাদের জীবন-মৃত্যু সব তাঁর হাতে। পৃথিবীর সবকিছুই তাঁর জ্ঞানের আওতাভুক্ত। তাঁর হাতে সব সৃষ্ট জীবের রিজিক। আমরা তাঁর ইবাদতকারী। তিনি ব্যতীত উপাসনার উপযুক্ত আর কেউ নেই। এ সবকিছু মনে-প্রাণে বিশ্বাস করা ও স্বীকার করা হলো বান্দার উপর আল্লাহর হক। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে মানুষকে বসবাস করতে হয়। আমরা পিতা-মাতা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের নিয়ে সামাজিকভাবে একসাথে বসবাস করি। একজনের সুখে-দুঃখে অন্যজন সাড়া দিই। বিপদাপদে একে অপরকে সাহায্য-সহযোগিতা করি। পরস্পরের প্রতি এ সহানুভূতি দায়িত্ব হলো হাক্কুল ইবাদ, অর্থাৎ বান্দার হক বা অধিকার। মানুষের প্রতি মানুষের হক বা অধিকারকে আটটি ভাগে ভাগ করা যায় যেমন : ১. নিকটাত্মীয়ের হক; ২. দূরাত্মীয়ের হক; ৩. প্রতিবেশীর হক; ৪. দেশবাসীর হক; ৫. শাসক-শাসিতের হক; ৬. সাধারণ মানুষের হক; ৭. অভাবী লোকের হক এবং ৮. অমুসলিমদের হক। প্রতিটি মুসলমানের আল্লাহর হক পালন করার সাথে সাথে সমভাবে মানুষের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সচেষ্ট হতে হবে। সাওম আরবি শব্দ। এর ফারসি প্রতিশব্দ রোজা, যা বাংলা ভাষায় গ্রহণ করা হয়েছে। সাওমের আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় সাওম হলোÑ সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় নিয়তের সাথে পানাহার ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তি থেকে বিরত থাকা। প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেক নারী-পুরুষের উপর রমজান মাসের এক মাস সাওম পালন ফরজ। রোজা ইসলাম ধর্মের পঞ্চম স্তম্ভের একটি। আল্লাহ মানুষের ধৈর্যের শিক্ষাদান ও বিভিন্ন রিপু দমনে রোজা ফরজ করেছেন। রোজা পালনের বিধান পূর্ববর্তী সব উম্মতের জন্য অপরিহার্য ইবাদত ছিল। এ প্রসঙ্গে মহাল আল্লাহ বলেন ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হলো, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতগণের উপর, যেন তোমরা তাকওয়া (আল্লাহভীতি) অর্জন করতে পারো।’ (সূরা বাকারা-১৮৩) রোজা সম্পর্কে আল্লাহ অন্য এক আয়াতে বলেন ‘রমজান মাস এমন মাস, যার ভেতর কুরআন শরিফ নাজিল করা হয়েছে, যা মানুষের পথপ্রদর্শক এবং সত্য পথ প্রদর্শনের ও সত্য-মিথ্যার প্রভেদ করার স্পষ্ট নিদর্শন। তোমাদের ভেতরে যে কেউ রমজান মাস প্রাপ্ত, সে যেন তাতে রোজা রাখে। যে ব্যক্তি পীড়িত হয় কিংবা প্রবাসে (সফরে) থাকে, সে ব্যক্তি যেন (ইফতারের দিবসগুলোর) পরিমাণ হিসাব করে পরবর্তী দিবসে রোজা রাখে।’ (সূরা বাকারা-১৮৫) রোজা পালন করলে মানুষ পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়। ধনীরা গরিবের অনাহারে-অর্ধাহারে জীবনযাপনের কষ্ট অনুধাবন করতে পারে। ফলে তারা দানখয়রাতে উৎসাহিত হয়। রোজা পালনের মাধ্যমে মানুষ হিংসা, বিদ্বেষ, পরনিন্দা, ধূমপানে আসক্তি ইত্যাদি বদভ্যাস ত্যাগ করতে পারে। রমজান মাসে আল্লাহ তায়ালা বিশ্বমানবের মুক্তি সনদ সর্বাঙ্গীণ জীবনব্যবস্থা পবিত্র কুরআন নাজিল করেছেন। এর দ্বারা রমজান মাসের বিশেষ ফজিলতের কথা প্রমাণিত হয়। রমজান মাসে আল্লাহ দুনিয়ার সব প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের জন্য বিশেষ ইবাদত রোজা ফরজ করে অশেষ নেকি হাসিলের এবং আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও দোজখের কঠিন শাস্তি থেকে মুক্তি লাভের বিশেষ সুযোগ দিয়েছেন। এ মাসে তারাবির নামাজ আদায় করে আল্লাহর বান্দারা তাঁর নৈকট্য অর্জনের সৌভাগ্য লাভ করে। এ মাসের অন্য অনন্য বৈশিষ্ট হলো এ মাসে যে ব্যক্তি একটি নফল ইবাদত আদায় করে সে অন্য মাসের একটি ফরজ আদায় করার সমপরিমাণ সওয়াব পাবে। আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরজ আদায় করে, সে অন্যান্য মাসের ৭০টি ফরজ কাজ আদায় করার সওয়াব লাভ করবে। এ মাসে এমন একটি রাত আছে যাকে বলা হয় ‘কদরের রাত’। এ রাতে যারা ইবাদত-বন্দেগি করবে তারা এক হাজার মাসের ইবাদত-বন্দেগি করার সওয়াবের তুল্য সওয়াব পাবে। এ মাসে ঈমানদারদের রিজিক আল্লাহ বাড়িয়ে দেন। এ মাসে রোজাদারকে ইফতার করালে অশেষ সওয়াবের ভাগীদার হওয়া যায়। শবেকদরের রাত কোনটি সে বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কুরআন মাজিদে কিছু বলা হয়নি। হুজুর পাক সা:-কে সাহাবিরা শবেকদর বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘রমজানের শেষ ১০ দিনের বিজোড় তারিখে শবেকদরের তালাশ করো। শবেকদর যেন কোনোভাবে ছুটে না যায় সে জন্য অনেক মুমিন মুসলমান রমজানের শেষ ১০ দিন এতেকাফ পালন করেন। ইমাম আবু হানিফা রহ:-এর মতে, ২৭ রমজান হলো শবেকদরের রাত। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, সূরা কদরে ‘লাইলাতুল কদর’ বাক্যটি তিনবার উল্লেখ করা হয়েছে এবং বাক্যটি লিখতে ৯টি হরফ ব্যবহৃত হয়েছে। ৯ কে তিন দিয়ে গুণ করলে ২৭ হয়। এ কারণে তাঁর ব্যাখ্যানুযায়ী রমজানের ২৭ তারিখের রাত হলো শবেকদর, অর্থাৎ কুরআন নাজিলের রাত। হাদিস শরিফে আছে, যে ব্যক্তি রোজাদারকে ইফতার করায়, তার বরকতে সে ব্যক্তি সব পাপ থেকে নাজাত লাভ করে এবং দোজখ থেকেও তার মুক্তি লাভ ঘটবে। আর ওই রোজাদার ব্যক্তি রোজার বদলে যে সওয়াব লাভ করবে, সেও তার সমপরিমাণ সওয়াবের ভাগীদার হবে। এর দ্বারা রোজাদারের সওয়াব কম করা হবে না। হুজুর পাক সা:-এর পবিত্র জবান হতে এ কথা শ্রবণ করার পর উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের প্রত্যেকের এমন খানাপিনা নেই, যার দ্বারা রোজাদারকে ইফতার করাতে পারি। তখন হুজুর পাক সা: বললেন, ‘একটি খুরমা, একটু দুধ, একটু পানি দিয়ে যে ব্যক্তি রোজাদারকে ইফতার করাবে, সে ব্যক্তি এ সওয়াব হাসিল করবে।’ রমজান মাস এত বরকতপূর্ণ যে, এর কোনো তুলনা নেই। এ মাসটি উম্মতে মুহাম্মদির জন্য আল্লাহর খাস রহমত। হুজুর পাক সা: আরো বলেন, ‘আমার উম্মতদের রমজান মাসে এমন পাঁচটি নিয়ামত দান করা হয়েছে, যা পূর্ববর্তী কোনো নবীর উম্মতদের দান করা হয়নি। এ নিয়ামতগুলো হলো ক. রোজাদারের মুখের ঘ্রাণ আল্লাহর নিকট মেশক বা কস্তুরির চাইতেও অধিক সুগন্ধি বলে বিবেচিত; খ. এ মাসে রোজাদারের পক্ষ হয়ে পানির মাছ আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে; গ. রোজার মাসে প্রতিদিন বেহেশতকে নতুন সাজে সাজানো হয় এবং আল্লাহ পাক বেহেশতদের উদ্দেশ্য করে বলেন ‘আমার নেক বান্দারা পৃথিবীর দুঃখপূর্ণ জীবন শেষ করে তোমাদের বুকে স্থান নিতে শিগগির আসছে; ঘ. রমজান মাসে শয়তানকে বন্দী করে রাখা হয়। এ জন্য শয়তান অন্য মাসের মতো এ মাসে রোজাদারকে ধোঁকা ও বিভ্রান্তিতে ফেলতে পারে না এবং ঙ. এ মাসের শেষ রাতে রোজাদার বান্দাদের সব গুনাহ থেকে ক্ষমা পাওয়ার কথা ঘোষণা দেয়া হয়। কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে আত্মরক্ষার হাতিয়ার হলো রোজা। রোজা পালনের মাধ্যমে পানাহারে নিয়মানুবর্তিতার অভ্যাস গড়ে ওঠে। এতে অনেক রোগ দূর হয় ও স্বাস্থ্য ভালো থাকে। রোজাদার ব্যক্তি নিম্নের ছয়টি বিষয় যত্নসহকারে আমল করতে পারলে আল্লাহর রহমতে রোজার সওয়াব, বরকত লাভ করে ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ এবং সাফল্য লাভ করতে পারবে ১. রোজাদার নিজের চোখের নজরকে হিফাজত করবে। শরিয়তে জায়েজ নেই এমন কিছুর প্রতি চোখের নজর যাতে না পড়ে এর প্রতি সতর্ক থাকা। এমনকি স্বামী-স্ত্রী উভয়ের দিকে এমনভাবে তাকাবে না যাতে একের প্রতি অন্যের কামভাব জাগ্রত হয়। ২. রোজাদার নিজের জবানকে হিফাজত করবে। অর্থাৎ মিথ্যা কথা বলা, বাজে কথা বলা, অন্যের গিবত বা কুৎসা করা, কাউকে গালিগালাজ করা ইত্যাদি থেকে নিজেকে বিরত রাখবে। রোজা রেখে জবান সংযত না করলে রোজার বরকত থাকে না। হুজুর পাক সা: বলেন, ‘কোনো রোজাদারের সাথে যদি কেউ ঝগড়া করতে চায়, তবে রোজাদার ব্যক্তি যেন তাকে বলে দেয়, আমি রোজা রেখেছি।’ (অর্থাৎ অন্যের উসকানি সত্ত্বেও ঝগড়ায় জড়িত না হয়ে রোজার মর্যাদা রক্ষা করবে) আর কথা বলার পরও যদি ওই ব্যক্তি না শুনে, তবে নিজ মনকে এ বলে সান্ত্বনা দেবে যে, রোজা রেখে তার পক্ষে আত্মকলহে লিপ্ত না হওয়া উচিত। অন্যের কুৎসা (গিবত) বলা কবিরা গুনাহ। অনেকে এটিকে কবিরা গুনার চেয়েও নিকৃষ্ট বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ৩. রোজাদার নিজ কানের হিফাজত করবে। যে সব বাক্য বলা পাপ তা শুনাও পাপ। হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে যে গিবত করে আর যে ব্যক্তি তা শ্রবণ করে উভয়ে গুনাহগার। ৪. শরীরের অন্য সব অঙ্গকে সমস্ত অন্যায় কার্যকলাপ থেকে ফিরিয়ে রাখবে। যেমন হাত দিয়ে অন্যায়ভাবে কিছু স্পর্শ না করা, পা দিয়ে কোনো খারাপ পথে না যাওয়া ইত্যাদি। ৫. হালাল রোজগার দিয়ে হালাল বস্তু ক্রয় করে ইফতার করবে। হাদিস শরিফে আছে ‘হারাম বস্তু যদি এক গ্লাস পরিমাণও খায়, তাতে ৪০ দিনের ইবাদত-বন্দেগি নষ্ট হয়ে যায়। অতএব, হারাম বস্তু দিয়ে যাতে ইফতার করতে না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে এবং ৬. ইফতার সাহরিতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাওয়া যাবে না। কেন না, রোজার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের সংযমী হওয়া এবং মানুষের অন্তরের পশুশক্তিকে নিস্তেজকরত আত্মার শক্তিকে সজীব করা। মাত্রাতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ দেহকে সবল করে পাশবিকশক্তি জোরদার করে এবং আত্মার শক্তিকে কমিয়ে দেয়। এ জন্য মুমিন মুসলমানরা সবসময় বিশেষত রোজার মাসে পরিমিত খাদ্য গ্রহণে তৃপ্ত হয়ে থাকেন। রমজানের এক মাস ইবাদত-বন্দেগি ও সংযমের মাধ্যমে মুসলমানরা নিজেদের সব ধরনের অন্যায় ও অনৈতিক কাজ থেকে দূরে রাখার যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে তা পরবর্তী ১১ মাস ধরে রাখতে পারলে তাদের পক্ষে সব ধরনের অন্যায় ও অনৈতিক কাজ পরিহারপূর্বক জীবনধারণ সম্ভব। এরূপ জীবনধারণ যারা করতে পারবেন তাদের ইহকাল ও পরকাল উভয় সফল। লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: [email protected]