বায়ুদূষণ ও নাগরিক জীবন

বিশ্বব্যাপী শারীরিক অক্ষমতা ও মৃত্যুর কারণের তালিকায় বায়ুদূষণ শীর্ষে। অকাল শারীরিক দুর্বলতার কারণে আর্থিক ক্ষতি ক্রমেই বাড়ছে! ২০১৯ সালের তথ্যানুসারে বাংলাদেশের জিডিপির ৩.৯ থেকে ৪.৪ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে বায়ুদূষণের কারণে। অসুস্থ শ্রমশক্তি, শ্রমশক্তির অনুপস্থিতি-মাথাপ্রতি উৎপাদন হ্রাসের প্রক্রিয়ায় এই ক্ষতি হয়। একই সাথে স্বাস্থ্যসেবার বাড়তি ব্যয়, পরিবেশের অনাকাক্সিক্ষত দূষণজনিত ক্ষতি অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এর পরিমাণ বার্ষিক প্রায় ৮.১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্ব জিডিপির ৬.১ শতাংশ।

বিশ্বব্যাপী শারীরিক অক্ষমতা ও মৃত্যুর কারণের তালিকায় বায়ুদূষণ শীর্ষে। অকাল শারীরিক দুর্বলতার কারণে আর্থিক ক্ষতি ক্রমেই বাড়ছে! ২০১৯ সালের তথ্যানুসারে বাংলাদেশের জিডিপির ৩.৯ থেকে ৪.৪ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে বায়ুদূষণের কারণে। অসুস্থ শ্রমশক্তি, শ্রমশক্তির অনুপস্থিতি-মাথাপ্রতি উৎপাদন হ্রাসের প্রক্রিয়ায় এই ক্ষতি হয়। একই সাথে স্বাস্থ্যসেবার বাড়তি ব্যয়, পরিবেশের অনাকাক্সিক্ষত দূষণজনিত ক্ষতি অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এর পরিমাণ বার্ষিক প্রায় ৮.১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্ব জিডিপির ৬.১ শতাংশ। ২০২৫ সালের ১৮ জানুয়ারি প্রকাশিত তথ্যে জানা যায় (বাংলা ট্রিবিউন) বায়ুদূষণের প্রভাবে প্রতি বছর পাঁচ হাজার ২৫৮ শিশুসহ দেশে এক লাখ দুই হাজার ৪৫৬ জন মানুষ অকাল মৃত্যুবরণ করেছে, ৯ লাখ গর্ভবতী মা অকাল প্রসব করছে, প্রায় সাত লাখ শিশু গড় মানের চেয়ে কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে। বায়ুদূষণ সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে জরুরি বিভাগে আসছেন ছয় লাখ ৭০ হাজার রোগী। এসব রোগীর কারণে বছরে ২৩ কোটি ৩০ লাখ কর্মদিবস নষ্ট হচ্ছে। সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার (সিআরআই) নামক একটি সংস্থার জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বায়ুদূষণের কারণে স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় বাড়ার সাথে সাথে কমছে উৎপাদনশীলতা। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছেÑ বায়ুমানের উন্নতির পরিবর্তে ২০২২ সালে সরকার প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ধূলিকণার জাতীয় মান ১৫ মাইক্রোগ্রাম থেকে বাড়িয়ে ৩৫ মাইক্রোগ্রাম করার সিদ্ধান্ত নেয়। যা গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকির সাথে সাথে বায়ুমান উন্নয়নে স্বাভাবিকভাবেই বাধার সৃষ্টি করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২১ সালের নির্দেশিকা অনুসারে বায়ুর মান প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রামে নামিয়ে আনা সম্ভব হলে অকাল মৃত্যুর হার ৭৯ শতাংশ হ্রাস পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে অকাল মৃত্যু কমে যাওয়ার সম্ভাবনা ৮১ হাজার ২৮২ জন মানুষের, সাথে সাথে হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, শ্বাসতন্ত্রের অসুখ, অকাল প্রসব এবং হৃদরোগের মতো জরুরি স্বাস্থ্য ব্যয়ের পরিমাণও আনুপাতিক হারে কমার সম্ভাবনা আছে। ফলে কর্মক্ষেত্রে ২৬ কোটি ৩০ লাখ কর্মদিবসের উৎপাদনশীলতা বাড়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের তথ্যানুসারে বায়ুদূষণের কারণে মানুষের গড় আয়ু বৈশ্বিক ২.৭ বছর হ্রাস পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে কমেছে ৪.৮ বছর। বায়ুদূষণ বলতে সচরাচর বাতাসে ক্ষতিকারক পদার্থের উপস্থিতি ঝোঝায়। গ্যাস, দূষিত পদার্থকণা, ধূলিকণা, ধোঁয়া প্রভৃতির উপস্থিতি বোঝায়। এটি পরিবেশ বিপর্যয়ের একটি বড় কারণ। দ্রুতগতিতে জনসংখ্যা ও কলকারখানা বৃদ্ধি, অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন, আর্থসামাজিক পরিবর্তন, যানজট, গাড়ির নির্গত ধোঁয়া, নির্মাণসামগ্রীর ধূলিকণা, অবিশ্বাস্য দ্রততার সাথে জলাভূমি ভরাট, বন উজাড় সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সার্বিক বায়ুমান এখন বাসঅযোগ্য। ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে বায়ুদূষণের মাত্রা এখন বিপজ্জনক পর্যায়ের; যা জনসাধারণের স্বাস্থ্যে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ঢাকা শহরে গত এক বছরে নগরবাসী এক দিনের জন্যও গ্রহণযোগ্য বায়ুমান পায়নি। নগরবাসীর মধ্যে অগ্রহণযোগ্য বায়ুমানের কারণে ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যান্সার, তীব্র শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ এবং হৃদরোগের মতো প্রাণঘাতী অসুখের সংখ্যা বেড়েছে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আইকিউ এয়ারের তথ্যমতে, ফেব্রুয়ারি ২৫ সালে বেশির ভাগ সময় ঢাকা বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে বিশ্বে এক নম্বর অবস্থানে ছিল। দেশের ৬৪টি জেলার দু-একটি জেলা বাদে সর্বত্রই বায়ুমান গ্রহণযোগ্যতার অনেক নিচে ছিল। শীতকালে বৃষ্টি না হওয়ায় পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়েছে। এই দুঃসহ অবস্থার মধ্যেও চলছে নগরায়ন ও নির্মাণকাজ। শতবর্ষী গাছ কেটে চলছে উন্নয়নের নামে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। যততত্র ইটভাটা ও শিল্প কারখানা স্থাপনের কাজ। যানবাহনের কালো ধোঁয়ায় এখনো শ্বাস নিচ্ছে জনগণ। খোলা জায়গায় বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য পোড়ানোর কারণে বাতাস দূষিত হচ্ছে প্রতিনিয়িত। শহরের চতুর্দিকে বর্জ্য ভাগাড় তৈরি করায় বাড়ছে আশপাশের বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণ প্রতিরোধে জরুরি কার্যক্রম দরকার। ঢাকা শহরের ফুটপাথ, সড়ক বিভাজকে যেসব গাছ রয়েছে সেগুলোর যথাযথ পরিচর্যাসহ দ্রত বর্ধনশীল গাছ লাগানোর ক্র্যাশ প্রোগ্রাম হাতে নেয়া যেতে পারে। অনুমতি ছাড়া যেকোনো কারণেই হোক না কেন, গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে। উন্নয়নের আগে জীবন। জলাভূমি ভরাট দণ্ডনীয় অপরাধ ঘোষণা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা দরকার। ঢাকা শহরসহ সব শহরে কালো ধোঁয়া উদগীরণকারী যানবাহনকে সড়ক ব্যবহার না করার আইনি ব্যবস্থার বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। ছাদবাগানের অভ্যাসকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। লোকালয়ের আশপাশে বর্জ্য ভাগাড়গুলোর স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থাপনা করতে হবে। ইটভাটা, শিল্পকারখানা নির্মাণকাজের অনুমোদনের আগে এসবের স্বাস্থ্যক্ষতির পরিমাণ কঠোরভাবে নির্ণয় করা প্রয়োজন। পাহাড় ও বনভূমি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠোর আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন প্রয়োজন। নির্মাণসামগ্রী যেখানে সেখানে সুবিধাজনক স্থানে যেন ফেলে রেখে না যায় তা বন্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার প্রয়োজন। ঢাকা শহরে শীতকালে প্রতিদিন ৫০০ টন ধুলা সড়কে জমে এবং দুই হাজার টন বাতাসে ওড়ে যা ঢাকাকে ধুলোর শহরে পরিণত করে। ঢাকা শহরে সকাল বিকাল পর্যাপ্ত পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করার প্রয়োজন।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ [email protected]