আমলাদের কাজের উন্নয়ন ঘটাতে হবে

দায়িত্ব পালনের গুরুত্ব নিয়ে প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজন করা যেতে পারে; জনকল্যাণের প্রতি উৎসাহ বাড়াতে কর্মকর্তাদের মধ্যে সঠিক মানসিকতা গড়ে তোলাও জরুরি।

বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তাদের ‘অযোগ্যতা’ নিয়ে আলোচনা করার আগে কিছু বিষয় বিবেচনা করা জরুরি। সরকারি কর্মকর্তাদের কাজ এবং দক্ষতা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্ন হতে পারে এবং এর মধ্যে অনেক কর্মকর্তা দক্ষতা, সততা ও দায়িত্বশীলতার সাথে কাজ করেন। তবে কিছু সাধারণ চ্যালেঞ্জ বা দুর্বলতা রয়েছে, যেগুলো জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। এর মধ্যে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরা হলো :

দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি : বাংলাদেশে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি সরকারি প্রশাসনের একটি বড় সমস্যা হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে চিহ্নিত। এটি সরকারি সেবা, উন্নয়ন প্রকল্প ও জনসাধারণের আস্থার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।

দুর্নীতির বহুমাত্রিক প্রভাবের মধ্যে আছে : উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি প্রায়ই বাজেট অপচয় ও প্রকল্পের গুণগত মান কমানোর কারণ হয়। অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি অফিসে সেবা পেতে হলে ঘুষ দেয়ার অভিযোগ ওঠে। সরকারি কেনাকাটায় অস্বচ্ছতা ও অতিরিক্ত ব্যয়ের ঘটনা নিয়মিত। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রাধান্য পেলে কর্মকর্তারা প্রকৃত কাজ করার চেয়ে ব্যক্তিগত লাভের দিকেই মনোযোগ দেন।

সমাধান : দুর্নীতি প্রতিরোধে শক্তিশালী আইন ও প্রয়োগ; দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কার্যক্রম আরো শক্তিশালী এবং স্বাধীনভাবে পরিচালনা; সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া এবং সেবা প্রদান পদ্ধতি ডিজিটালাইজ করা; টেন্ডারপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার নিশ্চিত করা; জবাবদিহি বাড়ানো;

দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া, প্রত্যেক কর্মকর্তার কাজের সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ মূল্যায়নের ব্যবস্থা।

স্বজনপ্রীতির প্রভাব

যোগ্য প্রার্থীরা বঞ্চিত : সরকারি নিয়োগপ্রক্রিয়ায় স্বজনপ্রীতি বা প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপের কারণে মেধাবীরা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। প্রতিষ্ঠানের গুণগত মানের অবনতি ঘটে, যা সামগ্রিক কাজের মান কমায়। যোগ্যতা বিবেচনায় না রেখে নিয়োগ দেয়ার ফলে কার্যকর নেতৃত্ব তৈরি হয় না।

সমাধান : সরকারি চাকরির পরীক্ষা ও নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ মেধাভিত্তিক করতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে; পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া জনগণের কাছে উন্মুক্ত রাখতে হবে।

স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ নিয়োগ বোর্ড : নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজনীতি এবং প্রভাবমুক্ত একটি স্বাধীন কমিটি গঠন করতে হবে; নিয়োগপ্রক্রিয়ার নিয়মিত তদারকি ও অডিটের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

নিয়োগে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে তা বাতিল করতে হবে।

জনগণের আস্থার অভাব

জনগণের মধ্যে প্রশাসন নিয়ে হতাশা ও আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হয়।

উন্নয়ন প্রকল্প বা সরকারি সেবার মান সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়।

সমাধান : প্রশাসনে জবাবদিহি ও জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সরকারি সিদ্ধান্ত এবং কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণের কাছে স্বচ্ছ তথ্য সরবরাহ করতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে অডিট ও মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করতে হবে।

দক্ষতার অভাব

বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তাদের দক্ষতার অভাব নিয়ে উল্লিøখিত বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষতার উন্নয়নে দরকার নীতিগত পরিবর্তন, পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ। বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করলে কিছু মূল সমস্যা ও সম্ভাব্য সমাধান বেরিয়ে আসে :

পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব : অনেক কর্মকর্তার প্রশিক্ষণ শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞানেই সীমাবদ্ধ। বাস্তব কাজের চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব হয় না। নতুন প্রযুক্তি, সফটওয়্যার ও আন্তর্জাতিক মানের প্রশাসনিক পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান সীমিত।

সমাধান : নিয়মিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা : দেশ-বিদেশের উন্নত প্রশিক্ষণ মডেল অনুসরণ করে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দান।

আধুনিক প্রযুক্তি যেমন এআই, ডাটা অ্যানালিটিক্স এবং ডিজিটাল ব্যবস্থাপনার ওপর প্রশিক্ষণ চালু করা।

আন্তর্জাতিক মানের নেতৃত্বের অভাব : প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্ট্র্যাটেজিক চিন্তাভাবনা এবং আন্তর্জাতিক মানের পরিকল্পনার অভাব প্রকট। কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নির্ধারণ ও তার বাস্তবায়ন দক্ষতা অনুপস্থিত থাকে।

প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব : আধুনিক প্রযুক্তি যেমন ডিজিটাল সেবা, ই-গভর্ন্যান্স বা অনলাইন ডাটাবেজ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার অভাব অনেক ক্ষেত্রেই সেবা প্রদানে বিলম্ব ঘটায়।

সমাধান হলো কর্মকর্তাদের ডিজিটাল পদ্ধতির উপর প্রশিক্ষণ দেয়া। প্রত্যেক কর্মকর্তার কম্পিউটার ও সফটওয়্যার ব্যবহারের ওপর দক্ষতা বাড়ানো।

অনেক ক্ষেত্রে দক্ষতার অভাব থাকা সত্ত্বেও কর্মকর্তারা জবাবদিহির মুখোমুখি হন না। এটি দক্ষতার উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে। এজন্য দরকার কর্মকর্তাদের কাজের মান ও দক্ষতার নিয়মিত মূল্যায়ন। দক্ষ কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করে অন্যদের উৎসাহিত করা।

দায়িত্বহীনতা : প্রশাসনে দায়িত্বহীনতা একটি গুরুতর সমস্যা, যা জনসেবার মান এবং জনগণের আস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এটি সাধারণত দায়িত্ব পালনে উদাসীনতা, সময়মতো কাজ না করা এবং সেবা প্রদানে জটিলতার কারণে ঘটে। এর কারণ, প্রভাব এবং সম্ভাব্য সমাধান বিশ্লেষণ করা হলো :

দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজের গুরুত্ব না দিলে সেবার মান নষ্ট হয়। সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত না নেয়ার কারণে প্রশাসনিক কাজ জমে থাকে।

সমাধান : কর্মকর্তাদের কাজের ভিত্তিতে বার্ষিক মূল্যায়ন চালু করা। যারা সময়মতো এবং সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন, তাদের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করা। সময়সীমা নির্ধারণ : প্রতিটি কাজের জন্য সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ ও তা মনিটরিং করা। দায়িত্বে গাফিলতির জন্য শাস্তির ব্যবস্থা রাখা।

দায়িত্ব পালনের গুরুত্ব নিয়ে প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজন করা যেতে পারে; জনকল্যাণের প্রতি উৎসাহ বাড়াতে কর্মকর্তাদের মধ্যে সঠিক মানসিকতা গড়ে তোলাও জরুরি।

পেশাদারিত্বের অভাব : প্রশাসনে পেশাদারিত্বের অভাব একটি সাধারণ এবং গভীর সমস্যা। এর প্রধান কারণ অনেক কর্মকর্তা জনকল্যাণমূলক কাজের চেয়ে নিজের ব্যক্তিগত সুবিধার দিকে মনোযোগী; দায়িত্ব পালনের সময় অনেকে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থের জন্য সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করেন; অফিস সময়ে দায়িত্ব পালনে আগ্রহের অভাব এবং কাজ ফেলে রেখে ব্যক্তিগত কাজ করার প্রবণতা; কর্মকর্তাদের কাজে পরিকল্পনার অভাব দেখা যায়; অনেক সময় কর্মকর্তারা জনসাধারণের সাথে অহঙ্কারী বা উদাসীন আচরণ করেন।

এসবের পেছনে যে কারণ আছে তার মধ্যে অন্যতম হলো নৈতিক মূল্যবোধের অবনতি। এজন্য কর্মকর্তাদের জন্য নিয়মিত নৈতিক মূল্যবোধ ও পেশাদারিত্ব বাড়ানোর প্রশিক্ষণ আয়োজন করা যেতে পারে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনসেবার প্রতি দায়িত্বশীল মনোভাব তৈরি করা যেতে পারে। এছাড়া দায়িত্বে অবহেলা বা ক্ষমতার অপব্যবহার হলে দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

জনগণের অংশগ্রহণ : সরকারি সেবা মূল্যায়নে জনগণের মতামত নেয়া এবং কর্মকর্তাদের কাজের জবাবদিহি আরোপ করা প্রয়োজন। নতুন দক্ষতা অর্জনকে চাকরিতে উন্নতির শর্ত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

সময় ব্যবস্থাপনার উপর গুরুত্ব : কর্মকর্তাদের কাজের সময় পরিকল্পনা এবং সময়মতো কাজ শেষ করার জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়া। অফিস সময়ের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে নজরদারি চালানো।

সরকারি সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কাগজপত্র এবং জটিল নিয়মাবলি সময়ক্ষেপণের কারণ হয়। সেবা প্রদান প্রক্রিয়া ডিজিটাল না হওয়ায় কাজ ধীরগতিতে হয় এবং বিভিন্ন দফতরের মধ্যে কার্যকর যোগাযোগের অভাব সমস্যার সৃষ্টি করে।

সম্ভাব্য সমাধান : ডিজিটালাইজেশন : সেবাদান প্রক্রিয়া সহজ এবং দ্রুত করতে ই-গভর্ন্যান্স চালু করা; অনলাইনে আবেদন, ডক্যুমেন্ট যাচাই এবং সেবার অগ্রগতি ট্র্যাক করার ব্যবস্থা; প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সংখ্যা কমানো এবং অনলাইনে যাচাইয়ের ব্যবস্থা করা; দফতরগুলোর মধ্যে কার্যকর সমন্বয় গড়ে তোলা; প্রতি মাসে বা নির্দিষ্ট সময় পর সেবা প্রদানের অগ্রগতি মূল্যায়ন করা, সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে সরাসরি মতামত নেয়া।

রাজনৈতিক প্রভাব

স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চাপ প্রায়শ সমস্যার কারণ হয়। অনেক সময় সরকারি কর্মকর্তারা রাজনৈতিক নেতাদের ইচ্ছা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। ফলে কর্মকর্তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে এবং নীতি বাস্তবায়নে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না। সরকারি প্রকল্প বা সেবা বিতরণে দলীয় স্বার্থের প্রাধান্য দেয়া হয়, যা সাধারণ মানুষের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এক্ষেত্রে প্রশাসনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ করতে কার্যকর আইন প্রণয়ন করতে হবে। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নির্দিষ্ট সুরক্ষা ব্যবস্থা চালু করা, যাতে তারা রাজনৈতিক চাপ এড়াতে পারেন। রাজনীতি এবং প্রশাসনের সীমানা নির্ধারণ করে দু’ক্ষেত্রের মধ্যে ভারসাম্য আনতে হবে। নীতিমালা তৈরি করে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা জরুরি। তৃতীয় পক্ষের নজরদারি : সরকারি কার্যক্রমে নিরপেক্ষ তৃতীয় পক্ষের তদারকি নিশ্চিত করা এবং নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে রাজনৈতিক প্রভাবের ঘটনা তদন্ত করার জন্য স্বতন্ত্র কমিটি গঠন করা যেতে পারে।

বাংলাদেশকে পিছিয়ে রাখার জন্য আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর বাইরের প্রভাব রয়েছে যা কাটিয়ে ওঠা আমাদের জন্য একান্ত জরুরি, শত্রু রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থরক্ষা করতে অনেক সময় আমলারা ব্যস্ত থাকেন যা নিবিড়ভাবে মনিটর করা জরুরি।

লেখক : সিনিয়র ফেলো, এসআইপিজি,

নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি

e-mail : [email protected]