তিস্তা প্রকল্প : কোনো ইস্যু নয় জাতীয় সমস্যা

স্মরণযোগ্য, সব আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে প্রতিবেশী দেশটি উজানে গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করেছে। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনকে সম্পূর্ণ অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে আর সময়ক্ষেপণ না করে ১৯৯২ সালের ওয়াটার কনভেনশন এবং ১৯৯৭ সালের জাতিসঙ্ঘ পানিপ্রবাহ কনভেনশনে স্বাক্ষর করা আমাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। উত্তরাঞ্চলকে মরুকরণের হাত থেকে বাঁচাতে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার ব্যাপারে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কতটুকু এগিয়েছে, সে সম্পর্কে দেশের নদী বিশেষজ্ঞরা ওয়াকিবহাল নন। সব তথ্য তাদের জানাতে হবে

Salahuddin-Babar-1

ইস্যু ও প্রবলেম দু’টি শব্দ ইংরেজি; কিন্তু বাংলাদেশের সবাই জানেন ইস্যু শব্দের অর্থ বহু বিস্তৃত। তার একটি হচ্ছে বিতর্কের বিষয়। আর প্রবলেম বা সমস্যা। ইংরেজি অভিধানে রয়েছে, সমস্যা তা-ই যার দ্রুত সমাধান জরুরি। এখন আমরা মূল আলোচনায় প্রবেশ করতে চাই। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা নিয়ে দীর্ঘ দিনের যে আলোচনা। সেটি আসলে কোনো ইস্যু না সমস্যা। বস্তুত সেটি দেশের উত্তরাঞ্চলের দারিদ্র্যক্লিষ্ট কোটি মানুষের জীবন জীব-বৈচিত্র্য ও পরিবেশের জন্য ভয়ঙ্কর এক সমস্যা। এ কারণে প্রতি বছর দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। আজো তার সমাধানের বাস্তব কোনো পদক্ষেপ নেই। এটি এখন মৌসুমি আলাপ-আলোচনা তথা একটি ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী শাসনের দীর্ঘ দেড় দশকে তিস্তা নিয়ে বহু নাটক প্রহসন দেশবাসী দেখেছে, ইদানীং লিপ সার্ভিসের মতো কিছু কথা কানে আসছে। কিন্তু তিস্তাকূলের মানুষের সমস্যা সেই তিমিরেই। বহুমুখী তিস্তা সমস্যা সমাধানে পতিত লীগ এবং ‘বন্ধু রাষ্ট্র’ ভারত সরকারের দীর্ঘসূত্রতা ও নানা তালবাহানায় দীর্ঘ দিন ধরে ঝুলে আছে ওই বিস্ফোরণোন্মুখ সমস্যা। বিষয়টি নিয়ে অধ্যাপক ড. ইউনূস কোনো দ্রুত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছেন না। তবে চীন সফরে যাচ্ছেন, সেখানে তিস্তা ফলপ্রসূ আলোচনার সুযোগ হতে পারে। দেশের নদী বিশেষজ্ঞ অথবা বাংলাদেশের বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞরাও সরকারের তিস্তা নিয়ে কী মনোভাব সে ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট কোনো ভূমিকা বা দিকনির্দেশ পাচ্ছেন না। ফলে দুই দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন নদী তিস্তার পানিবণ্টন এবং দেশের উত্তরাঞ্চলের পরিবেশ, জীবন-জীবিকা জীব-বৈচিত্র্য রক্ষা এবং এ অঞ্চলের মরুকরণ সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এ সমস্যার সমাধানে যত বিলম্ব হবে ঠিক তত দেশের অর্থনীতিতে অপূরণীয় ক্ষতি রোধ করা সম্ভব হবে না। মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগের সুরাহা হবে না। এ দিকে ডেভেলপমেন্ট কিছু আছে। তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় ও তিস্তা মেগা প্রকল্প অবিলম্বে বাস্তবায়নের দাবিতে দু’দিনের সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি তিস্তা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে ওই কর্মসূচি পালিত হয়। এ কর্মসূচি উদ্বোধন করেছিলেন দলের মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং সমাপন অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি বক্তব্য দিয়েছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। নিঃসন্দেহে এ কর্মসূচি প্রশংসনীয়। তবে স্বাভাবিকভাবে এমন প্রশ্ন উঠতে পারে; এর ফলো-আপ কর্মসূচি নিয়ে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘আমরা ক্ষমতায় গেলে তিস্তা নিয়ে জাতিসঙ্ঘে যাবো।’ অনেকের ধারণা জাতিসঙ্ঘে যাওয়ার অর্থ তিস্তা সমস্যা ডিপ ফ্রিজে রেখে দেয়া। আরো প্রশ্ন উঠতে পারে, দলটি কি তিস্তাকে একটি ইস্যু হিসেবে দেখছে; নাকি সমস্যা হিসেবে মনে করে। সবার মনে রাখতে হবে, তিস্তা নিয়ে হেলাফেলা হলে আগামী নির্বাচনে ভোট পাওয়া নিয়ে সবাইকে সমস্যায় ফেলবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দেশব্যাপী জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে, ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাও’ স্লোগানে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের ব্যানারে এ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিল বিএনপিসহ এর মিত্ররা। এরপর তিস্তা নিয়ে যদি আর কোনো ধারাবাহিক কর্মসূচি না থাকে তবে তার বিরূপ প্রভাব ফেলবে গোটা উত্তরাঞ্চলে। ওই সমাবেশ থেকে এ কথাও বলা হয়েছিল, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেয়া হবে। এ বার্তা আশাব্যঞ্জক হলেও এ বাবদ যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন এবং কারিগরি সহায়তার প্রয়োজন পড়বে তার উৎসও এখনই জনগণকে জানাতে হবে। কেননা দেশবাসীর নিশ্চয় স্মরণ আছে; পতিত লীগ সরকার ও ভারত সরকার মিলে তিস্তা নিয়ে যা কিছু করেছে সেটি ছিল নিছক কালক্ষেপণ এবং বাংলাদেশের জন্য বিপুল আর্থিক ক্ষতির কারণ। তিস্তা নিয়ে বিএনপির কর্মসূচি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির নেতারা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, তিস্তা নদীর পানি নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের দুর্ভোগ অবসানে প্রতিবেশী ভারতের ওপর যেন চাপ তৈরি হয় সেটিই তাদের লক্ষ্য। এ কারণে সমমনা দল ছাড়াও তিস্তা অঞ্চলের অনেক সামাজিক সংগঠনকেও এ কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। তিস্তা ইস্যু কেন্দ্র করে কর্মসূচি দেয়া হলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে। কেউ মনে করছেন এটা শুধু ভারতই নয়, বরং ডিসেম্বরের সম্ভাব্য নির্বাচন সামনে রেখে জাতীয় ও আঞ্চলিকভাবে জনপ্রিয় ইস্যুগুলোর মাধ্যমে জনগণের আরো কাছে যাওয়া এবং এর মাধ্যমে মাঠের নিয়ন্ত্রণ পোক্ত করাই দলটির মূল উদ্দেশ্য। ১৯৭৪ সালে তিস্তা প্রকল্প শুরু হয়। ১৯৮৩ সালে একটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার মাধ্যমে দুই দেশের (বাংলাদেশ-ভারত) মধ্যে পানিবণ্টনের সিদ্ধান্ত হয়; কিন্তু সেটি কার্যকর করা যায়নি ভারতের বাধায়। সেই ১৯৭৪ সালে তিস্তা প্রকল্প শুরু হয়। ১৯৮৩ সালে একটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারত ও বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তিস্তার পানির ৩৯ শতাংশ ভারত এবং ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশ পাবে। ডিসেম্বর থেকে মার্চের জন্য ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ পানি ধরে রেখে ভারত ২০১১ সালে বাংলাদেশকে ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ পানি দিতে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতায় চুক্তিটি হয়নি। এটা যে একমাত্র কারণ তা কেন হবে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের এখানে ভূমিকা আরো জোরালো হওয়া উচিত। যদি সত্যিকার অর্থে ভারত তিস্তার একটি ন্যায়সঙ্গত সমাধান আনতে পারত তাহলে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যে একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা থাকত না। এ অস্বস্তি কখনো কমেছে, কখনো বেড়েছে। সম্প্রতি ভারতের এক ইংরেজি দৈনিকের প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর অস্বস্তি আরো বেড়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতের কাছে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়েছে। ঢাকা এখন দিল্লির পক্ষ থেকে উত্তরের অপেক্ষায় রয়েছে; কিন্তু উত্তর এখনো আসেনি। পানি সম্পর্কে তথ্য সাধারণ মানুষের জানা উচিত বলে সবাই মনে করেন। এটা করা না হওয়ায় ব্যাপক ভুল ধারণা তৈরি হচ্ছে। তথ্য-উপাত্তের স্বচ্ছতা আন্তঃসীমান্ত পানি সহযোগিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যার অভাবে ইতিবাচক ফল নিয়ে ভুল ধারণা তৈরি হতে পারে। গণমাধ্যমে বিচ্ছিন্ন তথ্য ও মতামত পরিবেশনে বিভ্রান্তি বাড়বে। দীর্ঘ মেয়াদে তিস্তা সমস্যার সমাধান ও এ নিয়ে যাবতীয় বিভ্রান্তি দূর করতে তথ্য গোপন রাখার কোনো কারণ নেই। সমস্যার চূড়ান্ত সমাধানে প্রকাশ্যে তথ্যভিত্তিক আলোচনা প্রয়োজন। কারণ, ১৯৭৪ সালে তিস্তা প্রকল্প শুরুর পর বহু বছর চলে গেছে, কিন্তু এ পর্যন্ত সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। ফলে ওই অঞ্চলে জন দুর্ভোগের কোনো শেষ নেই। তিস্তা চুক্তির পরিবর্তে এখন বেশি আলোচনা হচ্ছে নদী ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রকল্প ঘিরে। উত্তরাঞ্চলের এটি ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ নামে পরিচিত। প্রকল্পটি মূলত বাংলাদেশ অংশে বাস্তবায়ন করা হবে। তিস্তায় এ প্রকল্প যাচাই করতে বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পাওয়ার চায়না যৌথভাবে প্রায় তিন বছর সমীক্ষা করেছে। সমীক্ষা শেষে তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনার একটি প্রস্তাব তৈরি করে। ওই প্রকল্পের আওতায় তিস্তার নদী খনন, ভূমি উদ্ধার করে সেচ, নৌ চলাচল, পর্যটন, আবাসন ও শিল্পায়নের সম্ভাবনা তুলে ধরা হয়। এ প্রকল্পে আর্থিক কারিগরি সহায়তা দিতে চীন যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিল এবং বাংলাদেশ সরকারকে তাগাদা দিচ্ছিল, তখন তিস্তা প্রকল্পে নতুন প্রস্তাব নিয়ে সামনে আসে ভারত। ভারতের এমন প্রস্তাব দেয়ার মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দিান বাংলাদেশের পানি বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিমত এমন প্রস্তাব হচ্ছে নিছক কালক্ষেপণ এবং চীনকে এখান থেকে দূর করা, যা একান্তই ভারতের স্বার্থ সংরক্ষণ করা। অথচ চীনা প্রস্তাব তিস্তা অঞ্চলে নতুন এক সম্ভাবনার উন্মোচন করতে পারে। মনে হচ্ছে, অতীতের মতো এখনো যেন বাংলাদেশ তিস্তা প্রকল্প নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। এটা কি ভারতীয় চাপে? এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ নিজের স্বার্থ কি কারো চাপে জলাঞ্জলি দেবে। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৭৬ সালের মে মাসে ফারাক্কা লংমার্চ সংঘটিত হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে লংমার্চটি অনুষ্ঠিত হয়। ওই লংমার্চে ভারতের গঙ্গার পানিপ্রবাহকে তার ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে সরাতে নির্মিত ফারাক্কা ব্যারেজ ভেঙে ফেলার দাবি জানানো হয়, যার ফলে পদ্মা নদী শুকিয়ে যায় এবং বাংলাদেশে মরুভূমি তৈরি হতে চলেছে। এটি ছিল বাংলাদেশে গঙ্গার পানির ন্যায্য বণ্টনের দাবিতে ভারতের বিরুদ্ধে আন্দোলন। তার পর থেকে প্রতি বছর ১৬ মে বাংলাদেশে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ দিবস পালিত হয়। জাতি এখন আশা করে আগামীতে দ্রুত যাতে ‘তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন দিবস’ পালন করতে পারে। স্মরণযোগ্য, সব আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে প্রতিবেশী দেশটি উজানে গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করেছে। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনকে সম্পূর্ণ অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে আর সময়ক্ষেপণ না করে ১৯৯২ সালের ওয়াটার কনভেনশন এবং ১৯৯৭ সালের জাতিসঙ্ঘ পানিপ্রবাহ কনভেনশনে স্বাক্ষর করা আমাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। উত্তরাঞ্চলকে মরুকরণের হাত থেকে বাঁচাতে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার ব্যাপারে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কতটুকু এগিয়েছে, সে সম্পর্কে দেশের নদীবিশেষজ্ঞরা ওয়াকিবহাল নন। সব তথ্য তাদের জানাতে হবে।

[email protected]