আমাদের পাঠ্যবই কি স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে
পরমুহূর্তে আবার মনে হয়, আমি কেন এসব ভাবছি? আমি তো এখন অবসরপ্রাপ্ত, কেউ তো আমাকে এখন এ দায়িত্ব দেয়নি। তবে আশা জাগে কোনোদিন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, হাজী মোহাম্মদ মহসিন, নবাব সলিমুল্লাহ বা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো কেউ আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে বলবেন এস আমার সাথে আলোকিত পথ ধরে আলোর ভুবনে। অসম্ভব কিছু নয়। জুলাই বিপ্লব যদি প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পারে তবে আল্লাহর মেহেরবানিতে এটিও সম্ভব হতে পারে
বই হলো মানুষের সবচেয়ে বড় বন্ধু। চলার পথে বিশ্বস্ত সাথী। জ্ঞানের এক সমৃদ্ধ ভাণ্ডার। জ্ঞানপিপাসুদের সবচেয়ে বড় শিক্ষক। আর পাঠ্যপুস্তক? সে তো মানুষ গড়ার এক নির্ভেজাল কারিগর। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পথনির্দেশক। এ কারিগর যদি স্বার্থপর হয়, তার পথনির্দেশনা যদি হয় বিশৃঙ্খল-এলোমেলো আর উদ্দেশ্যহীন, তবে অনুসারীরা তো পথ হারা পথিকের মতো উদ্ভান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াবেই।
শিক্ষায় অনগ্রসর ব্রিটিশ ভারতের আমাদের এ অঞ্চলে আদর্শ পাঠ্যপুস্তকের বর্তমানে প্রচলিত ধারাটির প্রবর্তন ঘটেছিল মহামতি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও আরও কিছু নিঃস্বার্থ উদ্যোগীর হাত ধরে। তৃণমূল পর্যায় থেকেই সে উদ্যোগের ফলে আমরা ছোট বেলাতেই হাতে পেয়েছিলাম ‘আদর্শ লিপি’ ‘বর্ণ পরিচয়’ ‘আমার পড়া’ ‘এসো গুনতে শিখি’। মোটামুটি অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রাক-প্রথম শ্রেণী ও প্রথম শ্রেণীতেই এসব বই পড়ানো হতো।
দ্বিতীয় শ্রেণীতেও বাংলা ও গণিত এবং তৃতীয় শ্রেণী থেকে এর সঙ্গে যুক্ত হলো ইংরেজি (বর্ণ ও শব্দ পরিচয়) ও ইতিহাস (গল্পে গল্পে ইসলামের চার খলিফা ও মুঘল শাসনের পরিচয়)। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীতে এগুলোর সঙ্গে ভূগোল, স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও ড্রয়িং যুক্ত হয়। যখন আধুনিক কারিকুলাম-বিজ্ঞানের নাম গন্ধও ছিল না, এ বিষয়ে কোনো সমন্বিত ধারণাও ছিল না সেই সূচনার যুগেই কী চমৎকার পরিকল্পিত পাঠ্যক্রম সাজানো হয়েছিল এসব পাঠ্য বইতে তা দেখে অবাক না হয়ে পারা যায় না। এসব পাঠ্যক্রমে যেমন সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য দেখা যায় তেমনি রয়েছে সুন্দর উপস্থাপনাও। ছড়ায়-ছবিতে শিশুমনের সব খোরাকই ছিল বইয়ের পাতায় পাতায়। বাংলা বইতে সদা সত্য কথা বলিবে, মিথ্যা বলা মহাপাপ, সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি, সূয্যি মামা জাগার আগে উঠব আমি জেগে, ভোর হলো দোর খোল খুকুমনি উঠরে, ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে সুখ পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ অথবা মাকড়সার ছবি আর গল্প দিয়ে লিখা-একবার না পারিলে দেখ শতবার এবং নীতিবাক্য-Money is lost nothing is lost, health is lost something is lost, but character is lost then everything is lost.
এসব সুন্দর সুন্দর কথার মধ্যে দিয়ে দেশপ্রেমিক এবং নিজের মাটিকে ভালোবাসা সৎ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলার কী চমৎকার পরিকল্পিত উদ্যোগ দেখা যায় তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। এই যে কথাগুলো এগুলো শুধুই বইয়ের পাতায় মুদ্রিত কতগুলো মন ভোলানো ছন্দ নয়। এগুলো যেন শিশুদের দেখা আনন্দ আর হৈ হুল্লোড় এবং জীবন ছন্দের বাস্তব প্রতিচ্ছবিগুলোই বই-এর পাতায় অক্ষর হয়ে ফুটে উঠেছে। আর মাস্টার সাহেবের মুখের কথাগুলোই যেন প্রতিধ্বনিত হয়েছে। আর সে বই এর পাতায় অক্ষরগুলো যেন রীতিমতো এক একটি ছবি। দেখতে কী সুন্দর! শিশু মন ভরিয়ে দেয়। পড়াটা যেন মাঠের খেলার মতোই এক অনাবিল আনন্দ। বিশ্বাস করুন আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না। আমি নিজে একজন পঁচাত্তরোর্ধ্ব বয়সের শিক্ষক। শিক্ষকতার বয়স তো সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে গেছে আরো বছর দুয়েক আগেই, আর পাঠ্যপুস্তকের রচয়িতা তাও চল্লিশ তো হবেই। না না অনেক প্রাচীন নয়, এখনো আমার রচিত বই শিক্ষায়তনের গণ্ডিতে গড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সেই আমি ছোটবেলায় পঞ্চাশের দশকে (৫৫-৫৯) যে বই প্রাইমারি ক্লাসে পড়েছি তা আজকের কেউ দেখলে চমকে উঠবেন। প্রাইমারির বই প্রকাশ করত সিলভার বার্ডেড কোম্পানি (Silver Birded Co.)। ছাপা হতো লন্ডনের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসে। বইয়ের কাগজ ছিল ফটোগ্রাফিক glossy paper, অক্ষরগুলো ডাগর ডাগর ঝকঝকে যেন বই পড়তে শিশুদের দৃষ্টি শক্তিতে কোনো চাপ না পড়ে। বই কেতাবের মতো বড় আকারের। ঝকঝকে এমন বই পেলে কার না পড়তে ইচ্ছে করে বলুন। আর স্কুলে যাওয়া? আজকের মতো টেনে হিঁচড়ে বিছানা থেকে নামিয়ে চোখ ডলতে ডলতে ২০ কেজি ওজনের একটি ব্যাগ শিশুর অপ্রশস্ত কাঁধে চাপিয়ে দেয়ার মতো নয়। তখন স্কুল শুরু হতো সকাল ১০টা-১০.৩০টা। সুতরাং একটি শিশু তার মতো করে ঘুম থেকে ধীরে সুস্থে উঠে নাশতা করে কিছুটা বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে স্কুল যেত। তাও আবার আধা ঘণ্টা আগে স্কুলে পৌঁছাতে হবে। ক্লাস শুরুর আগে বই রেখে কিছুক্ষণ সামনের মাঠে খেলতে হবে না? ঘণ্টা বাজবে। তারপর হুড়মুড় করে খেলা রেখে ধংংবসনষু তে দাঁড়িয়ে যাওয়া। প্রথমে জাতীয় সঙ্গীত এবং এরপর ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’ গাওয়া এবং এরপর ক্লাসে ঢোকা ও পড়া শুরু। সে এক রীতিমতো উপভোগের উপাখ্যান। আবার বছরে তিন মাস তো বড় ছুটি আছেই। গ্রীষ্মে আম-কাঁঠাল খাওয়ার ছুটি এক মাস, রমজানের ছুটি এক মাস, আর দুর্গাপূজার এক মাস।
যা বলছিলাম, চমৎকার পাঠ্যপুস্তক। পাঠ্যপুস্তক তো নয় এ যেন ‘হ্যামিলটরে বংশীবাদক’। নতুন বই হাতে পেলে তাড়াতাড়ি পড়ে ফেলা ছিল এক নেশা। যেমন গদ্যের কথাগুলো তেমনি পদ্যের ছন্দ আর সহজ মনকাড়া সব প্রতিপাদ্য। বলুন কিভাবে ভুলি সেই ছড়া ‘কাজের ছেলে’-‘দাদখানি চাল, মসুরের ডাল, চিনি পাতা দই... ’। অথবা, ‘বাঁশ বাগানোর মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ঐ... ’। প্রথম দিককার গণিত আর ইংরেজি ছিল ছড়ায় ছবিতে তুলে ধরা। একমাত্র তৃতীয় শ্রেণী থেকেই গণিতে নামতা শেখা ছিল দারুণ মাথাব্যথা। সে যা-ই হোক, যে হিসাব আমি দিলাম প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে ২ খানি করে বই, তৃতীয় শ্রেণীতে ৪টি বই এবং চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীতে ৭টি করে বই পাঠ্য ছিল। অর্থাৎ আজকের মতো শিশুদের ঘাড় বাঁকা করে চাপিয়ে দেয়া বই ভর্তি ব্যাগের বোঝা ছিল না। সঙ্গে ছিল আয়েশি ভঙ্গিতে ৬ মাস পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ৬ মাস ছুটি ভোগের আমেজ।
আমরা নিজেরা এসব সুযোগ পুরোমাত্রায় উপভোগ করলেও তার ছিটেফোঁটাও ব্যবস্থা করতে পারিনি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। শিশুদের দেহমন বিকাশের জন্য একটি উপযুক্ত উপভোগ্য শিক্ষাব্যবস্থা আজও আমরা দাঁড় করাতে পারিনি। এটি শুধু যে আমাদের ব্যর্থতা তা নয়। এখন রীতিমতো কনটেন্ট চুরি করে এবং গুগল ট্রান্সলেটরের সাহায্য নিয়ে পাঠ্যপুস্তকের পাতা ভরছি। এমন সব অনৈতিক-অশোভন বিষয়বস্তু পশ্চিমা সমাজ থেকে ধার করে এনে পাঠ্যসূচি তৈরি করার এমন নির্লজ্জ উদ্যোগ পেছনে ফেলে আসা আমার পঞ্চাশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে আমি এর আগে আর কখনো দেখিনি। গত কয়েক বছরে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটাকেই একেবারে দুমড়ে-মুচড়ে নাস্তানাবুদ করে দিয়ে গেছে।
শিক্ষাব্যবস্থা মোটা দাগে দুটি নিয়ামকের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। একটি পাঠ্যপুস্তক আর অপরটি শিক্ষক। পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তুকে পরিবেশন যোগ্য করে উপস্থাপন করেন শিক্ষক। সে পারঙ্গমতা যদি না-ই থাকে তবে তিনি কিসের শিক্ষক? শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীদের পড়ানোর দায়িত্ব পেলেই শিক্ষক হওয়া যায় না। আজ থেকে ষাট সত্তর বছর আগের আমার জীবনে আসা কয়েকজন আদর্শ শিক্ষকের উদাহরণ দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করব শিক্ষক কেমন হওয়া উচিত। বাবার (শিক্ষা অফিসার) চাকরির সুবাদে আমার পুরো স্কুলশিক্ষা (১৯৫৫-৬৫) কাটে নোয়াখালীতে। প্রাইমারি স্কুলের ৪ জনের মধ্যে একজন চমৎকার লতিফ মাসসাব (মাস্টার সাহেব) আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক। অতি অল্প সময়ের মধ্যে পুরো একটি বিষয়কে শিক্ষার্থীদের সামনে সহজভাবে তুলে ধরার এক বিস্ময়কর গুণের অধিকারী ছিলেন তিনি। আমার এখনো মনে আছে ১৯৫৯ সালে পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষার জন্য রামগঞ্জ থেকে নোয়াখালী সদরে যাওয়ার সময় ৫ ঘণ্টার একটি পথ নৌকায় পার হতে হয়েছিল। এ সময়টিতে যখন আমাদের দু’টি নৌকার একটিতে আমার বাবার সঙ্গে থাকা মাঝি ডাকাতিয়া নদীর বক্ষেই জেলেদের থেকে কেনা ৪টি বড় ইলিশ মাছ কেটে ভাজা ও রান্না করছিলেন সে সময়ের মধ্যে আমাদের লতিফ মাসসাব অপর নৌকায় আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে বৃত্তি পরীক্ষার ৭টি বিষয় (বাংলা, ইংরেজি, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল, স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান ও ড্রয়িং) মুখে মুখে দু’বার revision করিয়ে দিয়েছিলেন। এক কথায় অভাবনীয়-অপূর্ব। সহজ-সরল এ শিক্ষক ততোধিক সহজ সরলভাবে অতি কঠিন বিষয়গুলো বুঝাতে পারতেন।
আমার এখনো মনে আছে একটি ক্লাসে ইংরেজি কঠিন lieutenant শব্দটির বানান তিনি সহজে শিখিয়েছিলেন এভাবে- তোরা সবাই বল আমার সঙ্গে ‘মিথ্যা তুমি দশটি পিপড়া’ (Lie u ten ant)। এভাবে শিখলে কী আর বানান ভুল হবে? তারপর প্রাইমারি ছেড়ে যখন সেকেন্ডারিতে গেলাম, নোয়াখালী জিলা স্কুলে ষোলজন শিক্ষকই অতুলনীয়। হেডমাস্টার জনাব আখতার-উজ-জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় অনার্স এবং মাস্টার্স ফার্স্টক্লাস গোল্ড মেডালিস্ট ও কালি নারায়ণ স্কলার অর্থাৎ সাবসিয়াডিয়ারি রসায়ন ও গণিতে সে বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নম্বরধারী। তিনি আমাদের উপরের ক্লাসে নাইন-টেন এ পদার্থবিদ্যা পড়াতেন। তবে আমাদের পাঠ্য বইগুলো কি স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলছে?
১৯৬০ সালে আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পরপরই একদিন তিনি আমাকে তার রুমে ডেকে পাঠালেন। বললেন, তুমি ক্লাসে ফার্স্ট বয়, প্রাইমারি স্কলারশিপে পুরো জেলায় চতুর্থ হয়েছে। এখন ষষ্ঠ শ্রেণির স্কলারশিপ পরীক্ষায় পুরো জেলায় ফার্স্ট হতে হবে। প্রতিদিন টিফিন পিরিয়ডে আমার রুমে চলে আসবে, আমি তোমাকে স্কলারশিপের গণিত বিষয়টি শিখিয়ে দেবো। সে এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। তিনি ক্লাস সিক্সেই তখনকার ভারতবর্ষে ম্যাট্রিক ক্লাসের সর্বাধিক প্রচলিত জনপ্রিয় ‘যাদবের পাটিগণিত’ বইটি পুরো করিয়ে দিলেন। ক্লাস সিক্সে স্কলারশিপ
পরীক্ষায় আমি পুরো চট্টগ্রাম বিভাগে (অর্থাৎ চট্টগ্রাম, পাবর্ত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও সিলেট জেলা) প্রথম হয়েছিলাম। একইভাবে অষ্টম শ্রেণীর জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায়ও প্রথম হয়েছিলাম।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, সেই যে স্যার আমাকে যাদবের পাটিগণিত পুরো করিয়ে দিলেন তারই ফলশ্রুতিতে SSC পরীক্ষা পর্যন্ত প্রতিটি পরীক্ষায় আমি গণিতে ১০০ নম্বর করেই পেয়েছি। শুধু কি তিনি? না, প্রত্যেক শিক্ষকই ছিলেন এক একটি উদাহরণ। আমাদের বাংলার পণ্ডিত স্যার ক্ষিতিশ চন্দ্র মণ্ডলের অসাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ না করলেই নয়। হাফহাতা ফতুয়ার সাথে ধুতি আর পায়ে টায়ারের স্যান্ডেল। টিচার্স রুম থেকে বেরিয়ে বিড়িতে শেষ টানগুলো দিতে দিতে দীর্ঘ বারান্দা পেরিয়ে এসে বিড়ির গোড়াটি নিভিয়ে দূরে ছুড়ে আমাদের ক্লাসে ঢুকেই প্রশ্ন, তুই বলত জায়া ও পতি এর সব পদ কী আর কোন সমাস? যখন তখন রাস্তা ঘাটে দেখা হলেই ব্যাকরণের কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন কেউ হয়নি আমাদের সহপাঠীদের কেউ এ কথা বলতে পারবে না। আমি হোস্টেলে থাকতাম। তার বাসাও কাছেই। একই দীঘিতে গোসল করতাম। ভয়ে ভয়ে থাকতাম যেন সামনে না পড়ি। কিন্তু না রেহাই নেই। দেখলেই ডেকে হয়তো জিজ্ঞেস করে বসলেন কী জন্য পুকুরে এসেছিস? স্যার, গোসল করতে। তাহলে বল, স্নানে আগত কোন সমাস আর সমস্ত পদ কী? স্যার, সপ্তমী তৎপুরুষ সমাস, আর সমস্ত পদ হলো ‘স্নানাগত’। আর এখানে সপ্তমী বিভক্তি ‘এ’ ব্যবহৃত হয়েছে। যা গোসল কর। কী সরল জীবন যাপন, কী মেধা আর কর্তব্যে একাগ্রতা। এঁরাই ছিলেন শিক্ষক, পুঁথিগত শিক্ষার পাশাপাশি শিখিয়ে গেছেন জীবন পদ্ধতি আর নৈতিকতা। শুধু কি স্কুল-কলেজে? না আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষকগণ ছিলেন দেশ রাজ্যের শিক্ষক শিরোমণি। প্রফেসর মোকরম হোসেন খুন্দকার ‘Best Scientist’ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন পুরো দেশে (পাকিস্তান)। আমাদেরই শিক্ষক প্রফেসর মফিজ উদ্দিন আহমদ পরবর্তীতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য হয়েছিলেন।
আজ আমাদের দেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে খরা চলছে। যথাযথ বই নেই, শিক্ষকের মতো শিক্ষক নেই অর্থাৎ শিক্ষার দুই স্তম্ভই নেই সেখানে তো শিক্ষা ক্ষেত্রে দিগন্তজোড়া কালো মেঘ জমে থাকবেই, চলার পথ ঝাপসা মনে হবেই। অনেক দুঃখে কথাগুলো বলতে হলো। অসহায় মনে ভাবছি তাহলে পঞ্চাশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে কী করলাম! নিজ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার দৈন্য দশা মোচনে এতটুকু ভূমিকা রাখতে পারলাম না। পরমুহূর্তে আবার মনে হয়, আমি কেন এসব ভাবছি? আমি তো এখন অবসরপ্রাপ্ত, কেউ তো আমাকে এখন এ দায়িত্ব দেয়নি। তবে আশা জাগে কোনোদিন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, হাজী মোহাম্মদ মহসিন, নবাব সলিমুল্লাহ বা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো কেউ আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে বলবেন এস আমার সাথে আলোকিত পথ ধরে আলোর ভুবনে। অসম্ভব কিছু নয়। জুলাই বিপ্লব যদি প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পারে তবে আল্লাহর মেহেরবানিতে এটিও সম্ভব হতে পারে।
লেখক : প্রাক্তন চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড