অর্থনীতিতে জাকাতের ভূমিকা
হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সমস্ত সৃষ্টি আল্লাহর বৃহৎ পরিবার। সব চেয়ে উত্তম ব্যক্তি সেই, যে মানুষের বেশি উপকার করে।’ আল্লাহ বলেন, ‘নিজের সম্পদের প্রবৃদ্ধিশীল অংশ থেকে শতকরা আড়াই ভাগ দিয়ে দিও, কারণ এটি আমার অংশ। এতে তোমাকে দেয়া আমার সব কিছুই তোমার জন্য বৈধ, স্থায়ী ও পবিত্র। আমার নিরাপত্তা ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তুমি পেয়ে যাবে। এর পর যদি অকৃতজ্ঞ লোকগুলো সব কিছু ভোগ করা সত্ত্বেও মালিকের ক্ষুদ্র অংশটি তার লোকদের না দেয়, তা হলে সে বিশ্বের সব চেয়ে বড় অকৃতজ্ঞ; সে শাস্তি ও বিচারের যোগ্য।’ এক কথায়, আল্লাহ মানুষকে সম্পদ দিয়েছেন এবং সাথে ধনীর সম্পদে গরিবের অধিকারের কথা বলেছেন। জাকাত প্রদানে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমে, মুদ্রাস্ফীতি কমে, ধনী-দরিদ্রের সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়, সমাজে শান্তি বৃদ্ধি পায় এবং জাকাত দাতার সম্পদে বরকত সৃষ্টি হয়। সুতরাং আসুন আমরা অর্জিত সম্পদ থেকে গরিবের হক আদায় করি
ড. মো: মিজানুর রহমান
জাকাত ইসলামী রাষ্ট্রের আয়ের অন্যতম উৎস। রাসূল সা: মদিনায় হিজরত করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলে সেই রাষ্ট্রের আয়ের উৎস ছিল বায়তুল মাল, গণিমত, জিজিয়া কর, ফাই, ওশর ও জাকাত। এই বিভিন্ন উৎসের মধ্যে সুষম সমাজ গঠনের লক্ষ্যে ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূলভিত্তি ছিল জাকাত। আল্লাহ কুরআনে অনেক জায়গায় জাকাতের সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি পৃথিবীতে যাই আছে সবই তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন’ (সূরা বাকারা, আয়াত-২৯)। মানুষের অর্জিত সম্পদ কেবল তারই নয়; বরং অন্যদেরও তাতে অধিকার আছে। এ অধিকার পূর্ণ করার উদ্দেশ্য সামনে রেখে অভাবী লোকদের মধ্যে তা বিতরণের জন্য জাকাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তা ছাড়া জাকাতের নির্দেশ এ জন্যও দেয়া হয়েছে যে, অনেক সময় কোনো লোক গরিবদের প্রতি নানা কারণে দৃষ্টি দিতে পারে না। সে জন্য জাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের বাঁচার ন্যূনতম অধিকার বিধিবদ্ধভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে এবং বায়তুল মালের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জাকাত সম্পদ পবিত্র করে : নামাজে যেমন আত্মা পবিত্র হয়, তেমনি জাকাতে সম্পদ পবিত্র হয়। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তোমরা জাকাত হিসেবে যা দাও সে ক্ষেত্রে এরাই সেই সব লোক, যারা (জাকাতের মাধ্যমে নিজেদের ধন-সম্পদ) বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে’ (সূরা রুম, আয়াত-৩৯)। রাসূল সা: বলেন, ‘যে ধনী ব্যক্তি নিজের ধন-সম্পদ থেকে জাকাত আদায় করে না, তার ধন-সম্পদকে জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে এবং উত্তপ্ত শলাকা দিয়ে তাদের কপালে এবং মুখমণ্ডলে দাগ দেয়া হবে এবং এ শাস্তির মেয়াদ ৫০ হাজার বছরের সমান হবে’ (বুখারি)। জাকাত গরিবদের ওপর কোনো অনুগ্রহ নয়, বরং এটি দানকারীর নিজের মঙ্গল এবং তার মাল পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করার এক ব্যবস্থা। এ ছাড়া জাকাত প্রদান করলে ধন-সম্পদে কমতি হয় না। আল্লাহ বলেন ‘শয়তান তোমাদের দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং সে তোমাদেরকে অশ্লীলতার আদেশ দেয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ নিজ পক্ষ থেকে তোমাদেরকে ক্ষমার প্রতিশ্রুতি দেন। বস্তুত আল্লাহ প্রাচুর্য দানকারী এবং সর্বজ্ঞ’ (সূরা বাকারা, আয়াত-২৬৮)। জাকাত দ্বারা অর্থ-সম্পদ এবং পণ্যদ্রব্য মজুদ করে রাখার অভ্যাসও দূর হয়, ফলে বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়ে। জাকাত অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে : সমাজে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে আকাশ-পাতাল অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে জাকাতের ভূমিকা অপরিসীম। রোজাদার ধনী ব্যক্তি রমজান মাসে জাকাত প্রদান এবং মুক্তহস্তে দান-খয়রাত ও সাদকা আদায় করে সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য আনয়নের চেষ্টা করে। কারণ তারা উপলব্ধি করেন, তাদের অর্থসম্পদে গরিব-দুঃখীদের নির্দিষ্ট অংশ প্রাপ্য। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘তাদের (ধনীর) সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের অধিকার’ (সূরা আল-জারিআত, আয়াত-১৯)। ফলে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য অনেকটা দূর হয়। জাকাত প্রদানের মাধ্যমে সমাজের ধনী-গরিবের বৈষম্য দূরীভূত হয়। জাকাত ঠিকমতো আদায় ও বিলি-বণ্টন হলে গরিব ও অভাবীরা সচ্ছল এবং উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ পায়। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন, ‘সম্পদ যেন শুধু তোমাদের ধনীদের মধ্যে আবর্তিত না হয়’ (সূরা হাশর, আয়াত-৭)। জাকাতের ওপর অর্থনীতির যে ভিত তৈরি হয়, তাতে ধনী-গরিবের বৈষম্য কমে যায়, ফলে সমাজে শান্তি আসে। সমাজের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাতে সম্পদ বণ্টিত হওয়ার ফলে সমাজে আসে অর্থের নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীল ও টেকসই অর্থনীতি। সমাজে থাকে না কোনো বিরোধ। জাকাত মুদ্রাস্ফীতি দূর করে : বাজার অর্থনীতিতে সাধারণ পণ্যের চাহিদার তুলনায় বাজারে পণ্যের জোগান হ্রাস পেলে পণ্যের দাম বাড়ে। কিন্তু পণ্যের দাম বাড়াতে চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত জোগান থাকার পরও দাম বাড়ানোর জন্য পণ্যের জোগান হ্রাস করে, অবৈধ মজুদ করে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করা হয়। এই মনোপলি বিজনেসের সাথে হিডেন কস্ট যোগ হলে দ্রব্যমূল্য আরো বাড়ে। একশ্রেণীর অসাধু মজুদদার বাজারে খাদ্য ও পণ্যদ্রব্যের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়ে দেয়। অথচ পৃথিবীর অন্য অনেক দেশে ক্রিসমাস বা ঈদ উপলক্ষে দ্রব্যমূল্য হ্রাস পায়। সেখানকার ব্যবসায়ীদের লক্ষ্য থাকে সঠিক মূল্যে রোজাদারের হাতে নির্ভেজাল পণ্যটি সরবরাহ করা। এ জন্য রাসূল সা: সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, ‘পাপী ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কেউ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দুষ্প্রাপ্যতার সময় গুদামজাত করে না’ (মুসলিম)। জাকাত প্রদানে সম্পদ বাড়ে যেভাবে : একটি সাধারণ ধারণা হলো, জাকাত দিলে সম্পদ কমে যাবে। আসলে জাকাত দিলে সম্পদ কমে না বরং বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ ওয়াদা করেছেন, জাকাত আদায়ের ফলে তিনি বান্দার সম্পদ দ্বিগুণ করে দেবেন।’ জাকাত তার দাতা-গ্রহীতা এমনকি সমাজের সবার অর্থনৈতিক উন্নতির সোপান। এর কারণ জাকাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করে। গরিব ও অভাবী মানুষের মধ্যে জাকাত বণ্টিত হলে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। ফলে এসব লোকের চাহিদা পূরণে পণ্যের বিক্রি বাড়ে। স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন ও জোগান বৃদ্ধি পায়, এতে মুনাফাও বেড়ে যায়। সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারিত হয়; অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়ে যায়। সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্টের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে বর্তমানে আনুমানিক এক লাখ কোটি টাকা জাকাত আদায়যোগ্য। জাকাত প্রদানকারী তার নিসাবের উপরের সম্পদে জাকাত দিয়েছেন; তার অর্থ হলো, এই টাকা তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত। এই এক লাখ কোটি টাকা জাকাত না দিলে জাকাত প্রদানকারীর টাকা ব্যাংকে জমা থাকবে। ব্যাংকের ওই টাকা অর্থনীতিতে তেমন কোনো ভূমিকা রাখবে না। কারণ ওই এক লাখ কোটি টাকা দিয়ে নতুন পণ্য উৎপাদন করলে এবং পাশাপাশি বাজারে ওই এক লাখ কোটি টাকার পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি করতে না পারলে পণ্য বিক্রি হবে না অথবা কম দামে বিক্রি হবে। ফলে, পণ্যের উৎপাদক ও বিক্রেতা, যারা জাকাত দিয়েছেন তাদের ব্যবসায় ক্ষতি হবে, ফলে তাদের সম্পদ কমে যাবে। অন্য দিকে, যদি ওই এক লাখ কোটি টাকা গরিবদের জাকাত দেয়া হয় তাহলে গরিবের পণ্য ক্রয়ের চাহিদা বেড়ে যাবে। তারা তাৎক্ষণিক বাজারে গিয়ে মৌলিক চাহিদার পণ্য ক্রয় করবে। ফলে বাজারে এক লাখ কোটি টাকার পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হবে। চাহিদা বৃদ্ধির কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যাবে, ফলে পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে হবে। আর এই বাড়তি পণ্যের উৎপাদক, সরবরাহকারী ও বিক্রেতা ওই জাকাত প্রদানকারী বড় লোক। অর্থাৎ জাকাত দিয়ে তার নিজের পণ্যের চাহিদা বাড়াল, সরবরাহ বাড়াল এবং চূড়ান্তভাবে দাম বাড়াল; ফলে জাকাত প্রদানকারীর সম্পদ বেড়ে গেল। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, একবার হজরত ইমাম জাফর সাদেক তার পুত্রকে বললেন, তোমার কাছে খরচ করার মতো কী আছে। পুত্র বললেন, ৪০ দিরহামের মতো আছে। ইমাম সাহেব বললেন, এটি দান করে দাও। পুত্র বললেন, আব্বা, আপনি ভেবে বলছেন তো? সংসারের ব্যয় নির্বাহের জন্য এ কয়টি দিরহামই আমাদের আছে। দিয়ে দিলে কাল থেকে খরচ করার মতো একটি কপর্দকও থাকবে না। ইমাম জাফর সাদিক বললেন, তুমি কি জানো না যে, প্রত্যেক জিনিসের যেমন একটি চাবিকাঠি থাকে, তেমনি সমৃদ্ধির চাবিকাঠি হচ্ছে দান? তুমি দিয়ে দাও। দেখো, আল্লাহই সম্পদে বরকত দেবেন। তা-ই হলো। এর মধ্যে ১০ দিনও যায়নি, তার আগেই অন্য একটি কার্যোপলক্ষে জাফর সাদিক এবং তার পুত্র চার হাজার দিনার পেলেন! আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা অন্যের জন্য যা কিছু ব্যয় করবে, তিনি তার প্রতিদান দেবেন। তিনিই শ্রেষ্ঠ রিজিকদাতা’ (সূরা সাবার, আয়াত-৩৯)। জাকাত প্রদানে সম্পদে বরকত হয় : আল্লাহর অভিপ্রায় হচ্ছে জাকাতের দ্বারা সম্পদ ও বরকত বাড়িয়ে দেয়া। দুনিয়াতে অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া যাবে, হারাম উপায়ে অর্জিত অর্থ-সম্পদের মালিকেরা চোখের পলকে পথের ফকির হয়ে গেছে। এক-দুই পুরুষের ব্যবধানে সুদিকারবারি ভিক্ষার থালা হাতে রাস্তায় নেমেছে। সুদভিত্তিক বিলিয়ন-ট্রিলিয়নের ব্যবসায় অকল্পনীয়ভাবে ধসে গেছে। অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ে নামী-দামি ব্যাংক ও করপোরেট ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে গেছে। জাকাত আল্লাহর দুনিয়ায় আল্লাহর প্রতিনিধিকে অর্থ দেয়া তথা আল্লাহকেই অর্থ দেয়ার মতোই। আল্লাহ এ মর্মে বলেছেন, ‘তোমরা যা কিছু আল্লাহর পথে ব্যয় করো এ সবই আল্লাহর কাছে সুরক্ষিত থাকে। আল্লাহ এসব বাড়াতে থাকেন। বহুগুণে বৃদ্ধির পর সেসব তোমাদের ফিরিয়ে দেয়া হবে।’ জাকাত দানের মাধ্যমে এক মুসলমানের প্রতি অন্য মুসলমানের হক আদায় হয়ে যায়। গরিব-দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটে। সমাজের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ বৃদ্ধি পায়, দারিদ্র্য দূর হয়। হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সমস্ত সৃষ্টি আল্লাহর বৃহৎ পরিবার। সব চেয়ে উত্তম ব্যক্তি সে-ই, যে মানুষের বেশি উপকার করে।’ আল্লাহ বলেন, ‘নিজের সম্পদের প্রবৃদ্ধিশীল অংশ থেকে শতকরা আড়াই ভাগ দিয়ে দিও, কারণ এটি আমার অংশ। এতে তোমাকে দেয়া আমার সব কিছুই তোমার জন্য বৈধ, স্থায়ী ও পবিত্র। আমার নিরাপত্তা ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তুমি পেয়ে যাবে। এর পর যদি অকৃতজ্ঞ লোকগুলো সব কিছু ভোগ করা সত্ত্বেও মালিকের ক্ষুদ্র অংশটি তার লোকদের না দেয়, তাহলে সে বিশ্বের সব চেয়ে বড় অকৃতজ্ঞ; সে শাস্তি ও বিচারের যোগ্য।’ এক কথায়, আল্লাহ মানুষকে সম্পদ দিয়েছেন এবং সাথে ধনীর সম্পদে গরিবের অধিকারের কথা বলেছেন। জাকাত প্রদানে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমে, মুদ্রাস্ফীতি কমে, ধনী-দরিদ্রের সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়, সমাজে শান্তি বৃদ্ধি পায় এবং জাকাত দাতার সম্পদে বরকত সৃষ্টি হয়। সুতরাং আসুন আমরা অর্জিত সম্পদ থেকে গরিবের হক আদায় করি।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট [email protected]