বীণা সিক্রির বাংলাদেশ প্রসঙ্গ

বীণা সিক্রি একজন বিশিষ্ট ভারতীয় কূটনীতিক ও শিক্ষাবিদ। তিনি ১৯৭১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসে ছিলেন। ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনের আগে তিনি ২০০০ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় ভারতের হাইকমিশনার এবং ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত হংকংয়ে ভারতের কনসাল জেনারেল ছিলেন। সিক্রি নয়াদিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। এ ছাড়া তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় জেন্ডার ক্ষমতায়নের ওপর একটি সংস্থা সাউথ এশিয়া উইমেনস নেটওয়ার্কের (সোয়ান) প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ও আহ্বায়ক।

Bazlur

ভারতের অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক বীণা সিক্রি সম্প্রতি ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনে একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেখানে বাংলাদেশ বিষয়ে তিনি বেশ কিছু মন্তব্য করেন। সে বিষয়টিই আমরা এই নিবন্ধে তুলে ধরব।

ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন একটি স্বাধীন গবেষণা কেন্দ্র। ভারতীয় রাজনীতির সমস্যা, চ্যালেঞ্জ ও সুযোগের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এই সংস্থা। ফাউন্ডেশনটি সমসাময়িক ভারত এবং এর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট, সমাজ-সভ্যতার লেন্সের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা চালায়। এর লক্ষ্য সচেতনতা বৃদ্ধি এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বের বিষয়ে মতামত দেয়া বা কোনো ইস্যু সমর্থন করা। ভারতের নামকরা ও অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিকরা এখানে কথা বলেন। বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করও এই ফাউন্ডেশনের সদস্য।

বীণা সিক্রি একজন বিশিষ্ট ভারতীয় কূটনীতিক ও শিক্ষাবিদ। তিনি ১৯৭১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসে ছিলেন। ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনের আগে তিনি ২০০০ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় ভারতের হাইকমিশনার এবং ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত হংকংয়ে ভারতের কনসাল জেনারেল ছিলেন। সিক্রি নয়াদিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। এ ছাড়া তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় জেন্ডার ক্ষমতায়নের ওপর একটি সংস্থা সাউথ এশিয়া উইমেনস নেটওয়ার্কের (সোয়ান) প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ও আহ্বায়ক।

বীণা সিক্রি তার কর্মজীবনে বেশ কয়েকটি সফল কূটনৈতিক আলোচনায় জড়িত ছিলেন। বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার থাকাকালে বীণা সিক্রি দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি বাণিজ্য, নিরাপত্তা, সাংস্কৃতিক বিনিময়সহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করেছেন। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্সের (আইসিসিআর) মহাপরিচালক হিসেবে বীণা সিক্রি ভারতের সাংস্কৃতিক কূটনীতি প্রচার করেন। সাংস্কৃতিক কূটনীতিতে তার প্রচেষ্টা ব্যাপকভাবে স্বীকৃত ও প্রশংসিত হয়। বীণা সিক্রি নিউ ইয়র্কে ভারতের স্থায়ী মিশনে (১৯৭৭-৮১) জাতিসঙ্ঘের সুরক্ষা কাউন্সিল ও ইকোসকসহ জাতিসঙ্ঘে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন।

বীণা সিক্রির কার্যকালে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। তিনি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে নিরাপত্তা উদ্বেগ মোকাবেলা এবং সীমান্ত ব্যবস্থাপনার উন্নতিতে কাজ করেছেন। বীণা সিক্রি বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন এবং সহ-সম্পাদনা করেছেন, যা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বোঝাপড়ায় অবদান রাখে।

মিসেস সিক্রি বাংলাদেশ সরকার ও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে যে বিশ্লেষণ দিয়েছেন সেগুলোর কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের দরকার নেই। এসবই তার নিজের কথা। আমরা এখানে তার বক্তব্যের কিছু অংশ তুলে ধরছি।

মিসেস সিক্রি এই বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, ইউনূস সরকারের আমলে বাংলাদেশে ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর জয়জয়কার, ফলে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তি ক্ষয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে তালেবানীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে- যার ক্রমবর্ধমান প্রভাব সমাজে সমস্যার সৃষ্টি করবে। জামায়াতে ইসলামী মূল খেলোয়াড় হিসেবে মঞ্চে উপস্থিত হয়েছে, দলটি পাকিস্তানের প্রভাবের মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে এবং ছোট ছোট ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে একত্রিত করার চেষ্টা করছে। আইএসআই বাংলাদেশে খুব সক্রিয় ছিল, জামায়াত তাদের বাহক ছিল, আইএসআই কখনোই চলে যায়নি, একাত্তর সালেও তারা সেখানে ছিল, জামায়াতে ইসলামী তখনো সেখানে ছিল, শেখ মুজিবের পরাজিতরা গোলাম আযমকে নির্বাসিত করেছিল, যিনি তখন জামায়াতে ইসলামীর আমির ছিলেন। কিন্তু তাকে ফিরে আসতে দেয়া হয়েছিল। এটি একটি রাজনৈতিক শক্তি ছিল।

বীণা বলেছেন, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সংবিধানকে সর্বোচ্চ দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না, তারা স্বীকার করে যে, তাদের নিজস্ব সংবিধান আছে সেটি- কুরআন। বাংলাদেশের সংবিধানকে স্বীকৃতি না দিলে কিভাবে তারা রাজনীতিতে অংশ নেবে?

অন্তর্বর্তীকালীন ইউনূস সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন শাসনের সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি খুব ভঙ্গুর। ইউনূস সম্পর্কে ক্রমাগত কথা বলা হচ্ছে, এটি তার শেষ মাস, তিনি জেনেভা যাচ্ছেন, অনেক উপদেষ্টারা কথা বলছেন, তাদের বলার মতো কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি নেই, আজকের প্রধান সমস্যাগুলোর একটি হলো এই অন্তর্বর্তীকালীন শাসনব্যবস্থা। যেমন তাদের সত্যিই কোনো সাংবিধানিক অবস্থান নেই, এখন তারা এমন একটি সংবিধানের শপথ নিয়েছে, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অনুমতি দেয় না। তাদের আর নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকার হিসেবে বর্ণনা করা যায় না। এই সরকারের কোনো রোডম্যাপ নেই নির্বাচনের জন্য কিন্তু নির্বাচন, এটি এমন একটি বিন্দু যার ওপর একধরনের ফল্ট লাইন বিকশিত।

সরকারব্যবস্থায় আপনি কেবল ৯০ দিনের জন্য সেখানে থাকবেন এবং সেই ৯০ দিনের মধ্যে আপনি কেবল যাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা, নির্বাচনের ব্যবস্থা করা, তারা সব ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। অনেক পুলিশ মারা গেছে, যে পুলিশের অনেকে এখনো কাজে ফিরে আসেনি, অনেক পুলিশ স্টেশন পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। তারা প্রায় ৪০০ থানা পুড়িয়েছে, ইসলামী ছাত্রশিবির অস্ত্রগুলো লুট করেছিল, এসব অস্ত্র এখন ব্যক্তিগত হাতে রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘ভারতের জন্য বলতে চাই, ১৯৭১ সালের স্মৃতি ধরে রাখতে হবে, এ জন্য একাত্তরের স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে হবে, কারণ আমাদের মনে রাখতে হবে, ১৯৭২ সালের সংবিধান, যা শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকার নিজেদের দিয়েছে, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সামাজিক ন্যায়বিচারের যেসব স্তম্ভ রয়েছে এসব স্তম্ভই ভারত ও বাংলাদেশের বন্ধুত্বের ভিত্তি।’

বাংলাদেশের চলমান বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে তিনি নিজের মতপ্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিগুলোর পুনর্গঠন করা হয়েছে, ইতিহাস পুনর্লিখন এবং বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয় পুনর্নির্মাণের একটি প্রয়াস লক্ষ্য করা গেছে।

মিসেস সিক্রি বলেন, পাকিস্তানের সাথে দ্রুত স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়া চলছে। তাদের মধ্যে বাণিজ্য যোগাযোগসহ সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ভারতের জন্য সঙ্কেত। এটি অবিশ্বাস্য যে মাত্র ছয় মাসের মধ্যে আগের সব সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ উল্টে গেছে।

বাংলাদেশ পাকিস্তানের সাথে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা আপগ্রেড করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের একজন সিনিয়র জেনারেল রাওয়ালপিন্ডিতে যান, তিনি সেনাপ্রধান এবং অন্যদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার করার কথা বলেন, তিনি বলেছিলেন আমরা বিমান কিনতে চাই থান্ডারবার্ড, চীনা এয়ারক্রাফট যেটি এখন পাকিস্তানেও তৈরি হচ্ছে। একজন সিনিয়র ডিজি স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালাইসিসের জন্য ঢাকায় ছিলেন, তিনি সেখানে খুব ভালো বৈঠক করেছিলেন এবং আবার এই প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ত্বরান্বিত করার বিষয়ে কথা বলেছেন, তবে তাদের সরে যেতে সময় লাগেনি তার মানে কি এই যে, বাংলাদেশের সেক্যুলার ভিত্তি যেমনটি আমরা জানি, শুরুটা নড়বড়ে ছিল।

মিসেস সিক্রি বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অবস্থা ও আইনশৃঙ্খলার ভাঙনের কথা উল্লেখ করেছেন, যা সরকারের অবস্থান আর দুর্বল করে তুলছে। বলেছেন, সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর নির্যাতন চলছে এবং তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। ৫ আগস্ট, যে মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা ছেড়ে চলে গেলেন, প্রথম টার্গেট ছিল হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ সংখ্যালঘুরা, তাদের ওপর নির্মমভাবে আক্রমণ করা হয়েছিল। লিঞ্চিং ও ধর্ষণ, হত্যা ও ভবন ধ্বংস এসব। এটি আশ্চর্যজনক যে, এবার সংখ্যালঘুরা বলেছে আমরা চলে যাবো না। তাই তারা একটি অবস্থান নিয়েছে এবং বলেছে, আমরা এই দেশের নাগরিক এবং আমরা আমাদের অধিকার চাই। বাংলাদেশে স্থিতিশীলতার জন্য এবং গণতন্ত্র পুনঃস্থাপনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে মুক্ত, ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

মিসেস সিক্রি কোথাও অতিরঞ্জিত করেছেন, কোথাও একপেশে কথা বলেছেন। কেন শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেন, বাংলাদেশ থেকে কী বিপুল পরিমাণ অর্থ লুট ও পাচার হলো, ব্যাংকগুলো ধ্বংসের মুখে পড়ল, সীমান্তে মানুষ হত্যা, ইত্যাদি কয়েক ডজন জরুরি বিষয় নিয়ে তিনি কিছুই বলেননি।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার