নেতানিয়াহু যেভাবে ইসরাইলের একচ্ছত্র নেতা হয়ে উঠেন
শেষ সময়ে নেতানিয়াহুকে কিভাবে স্মরণ করা হবে- এর উত্তরে সাবেক মধ্যপ্রাচ্য দূত অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, ‘ইসরাইলি রাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী এবং কোনো দ্বিধা বা আপত্তি ছাড়াই সবচেয়ে খারাপ প্রধানমন্ত্রী।‘

ইসরাইল ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু অন্য কারো চেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় রয়েছেন। তিনি ইসরাইলে জন্মগ্রহণকারী প্রথম নেতা, যার চরিত্র, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি দেশের মানুষকে প্রভাবিত করেছে এবং বিস্তৃতভাবে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ইসরাইলকে গঠন করেছে।
ফিলিস্তিনি সার্বভৌমত্বের ধারণার প্রতি ইসরাইলিদের একগুঁয়েমিকে মূর্ত করে তোলার মতো উস্কানিমূলক রাজনীতিবিদ আর কেউ দেখেনি। এমনকি এতটা নির্লিপ্ত জাতীয়তাবাদীও ছিল না।
এর বহু উদাহরণ রয়েছে। ১৯৯৫ সালের নভেম্বরে অসলো চুক্তির বিরোধী একজন ডানপন্থী ইসরাইলি কর্মীর হাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিনের হত্যার মাত্র কয়েক মাস আগেই নেতানিয়াহু ‘রবিনের মৃত্যু’ স্লোগানের মধ্য দিয়ে একটি উপহাসমূলক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার নেতৃত্ব দেন। পরে রবিনের স্ত্রী নেতানিয়াহুকে ‘নিষ্ঠুর’ ও ‘দুঃস্বপ্ন’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
নেতানিয়াহু ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনায় রাজি হন। কিন্তু পরে জেরুসালেমে পূর্ণ ইসরাইলি সার্বভৌমত্ব ও ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের অসামরিকীকরণের দাবি করে আলোচনা পণ্ড করে দেন।
তিনি দুর্নীতির অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন। তবে তিনি তা অস্বীকার করে বিচার বিভাগ সংস্কারের চেষ্টা করেছেন। এই ধরনের পদক্ষেপগুলো মিত্রদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা নষ্ট করেছে ও তার শত্রুদের মধ্যে চিরস্থায়ী ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
বিক্ষোভে বক্তৃতা দেয়া শৈশবের বন্ধু উজি বেলার ২০২৪ সালের দ্য বিবি ফাইলস ডকুমেন্টারিতে বলেছিলেন, ‘তিনি সর্বদাই মিথ্যা বলেন। তার কাছে মিথ্যা বলা খারাপ কিছু নয়। সত্যি বলতে তিনি এতে কোনো সমস্যা বোধ করেন না।’
ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও লিকুদ নেতা আইজ্যাক শামির একবার নেতানিয়াহুকে ‘ধ্বংসের দেবদূত’ বলেছিলেন।
কিন্তু ইসরাইলিদের জন্য সম্ভবত সবচেয়ে খারাপ ছিল নেতানিয়াহুর ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে আক্রমণ প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হওয়া। এ সময় এক হাজার ১০০ জনেরও বেশি ইসরাইলি নিহত হয়েছিল। নেতানিয়াহু একইদিনে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। গাজায় ১৫ মাস ধরে চলমান ইসরাইলের গণহত্যায় ৪৬ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
লেবানন, ইয়েমেন ও সিরিয়ায় আক্রমণ, বোমা হামলা ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে ইসরাইল। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ২০২৪ সালের নভেম্বরে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে।
রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্টদের সাবেক মধ্যপ্রাচ্য দূত অ্যারন ডেভিড মিলার মিডল ইস্ট আইকে বলেন, নেতানিয়াহু নিঃসন্দেহে ইসরাইলের সর্বকালের সবচেয়ে কার্যকর রাজনীতিবিদ।
রাজনীতিতে প্রবেশের আগে বিশ্বের প্রতি নেতানিয়াহুর যে দৃষ্টিভঙ্গি তা কিভাবে প্রভাবিত হয়েছিল, যা তাকে এ পর্যায়ে এনেছে? নেতানিয়াহুর ইসরাইলের একচ্ছত্র নেতা হয়ে উঠার প্রভাবগুলো মিডল ইস্ট আই তাদের এক প্রতিবেদনে বিস্তারিত তুলে ধরেছে।
বেনজিয়ন নেতানিয়াহু: আপনার বাবাকে সম্মান করুন
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ১৯৪৯ সালের ২১ অক্টোবর তেল আবিবে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে থেকে ফিরে আসার তিন বছর পর তার জন্ম হয়। নেতানিয়াহুর মা জিলা সেগাল অটোমান-শাসিত ফিলিস্তিনে বেড়ে ওঠেন। তার বাবা বেনজিয়ন নেতানিয়াহু ওয়ারশতে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও পরিবারটি ধর্মনিরপেক্ষ ছিল, তবে বাইবেলের ইতিহাস এর বিকাশ ও আদর্শে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করেছিল।
ইতিহাসবিদ বেনজিয়ন নেতানিয়াহু ইহুদিবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী ইরগুনের প্রতিষ্ঠাতা ও নেতৃত্বদানকারী জেভ জাবোটিনস্কির ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন। তার পরামর্শদাতার মতো, তিনি বিশ্বাস করতেন ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়ন ব্রিটিশ ম্যান্ডেট ও আরব অঞ্চল উভয়ের প্রতিই খুব বেশি সমঝোতাপ্রিয় ছিলেন, যাদের উভয়কেই ইসরাইল সৃষ্টির জন্য বলপ্রয়োগের মাধ্যমে পরাজিত করতে হবে।
ফিলিস্তিনের আরব জনগোষ্ঠীর প্রতি বেনজিয়নের মনোভাব সারাজীবন ধরেই আপসহীন ছিল। তার মৃত্যুর তিন বছর আগে ২০০৯ সালে তিনি ইসরাইলি সংবাদপত্র মারিভের একজন সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে বলেছিলেন, ‘ইসরাইলি আরবদের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের যদি সুযোগ থাকত, তাহলে তারা আমাদের নির্মূল করত।‘
সাবেক ইসরাইলি আলোচক ও বিশ্লেষক ড্যানিয়েল লেভি মিডল ইস্ট আইকে জানান, নেতানিয়াহুর বিশ্বদৃষ্টির এই আদর্শিক উপাদানটি গুরুত্বপূর্ণ, যা তরুণ বয়সে তার ওপর প্রভাব ফেলেছিল। অথবা তাকে কেবল ব্যক্তিগত উন্নতিতে আগ্রহী একজন সুবিধাবাদী হিসেবে হিসেবে উড়িয়ে দেয়া উচিত নয়।
বৃহত্তর ইসরাইল: স্বদেশকে প্রসারিত করুন
নেতানিয়াহু ও তার ভাইবোনেরা শৈশবের বেশিভাগ সময় যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ায় কাটিয়েছেন। সেখানে তাদের বাবা ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ সাল এবং ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত একটি ইহুদি কলেজে শিক্ষকতা করতেন।
যদিও নেতানিয়াহু আট বছর বয়সে নিউ ইয়র্কের স্কুলে আসার সময় কেবল হিব্রু ভাষায় কথা বলতেন বলে মনে পড়ে, তবে তার শৈশবের এক বন্ধু পরে তাকে ‘সম্পূর্ণ আমেরিকানো‘ বলে বর্ণনা করেছিলেন। প্রতি গ্রীষ্ম ইসরাইলে কাটালেও তিনি তার ভবিষ্যৎ যুক্তরাষ্ট্রে দেখতেন।
বেনজিয়নের প্রভাব তার ছেলের মধ্যে ‘উদারপন্থী, ডেমোক্র্যাট-ভোটিং মার্কিন ইহুদিদের প্রতি ঘৃণা‘ জাগিয়ে তোলে। ১৪ বছর বয়সের মধ্যে নেতানিয়াহু ইসরাইলে তার বামপন্থী বন্ধুদের ‘সমাজতন্ত্রের কুফল‘ সম্পর্কে বক্তৃতা দিতেন। তিনি তার পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে এই নীতিগুলো বহন করেছেন।
নেতানিয়াহু ১৯৬৭ সালে ইসরাইল ও আরব রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে মিসর, সিরিয়া ও জর্ডানের জোটের মধ্যে যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য দেশে ফিরে আসেন। তিনি ১৯৭২ সাল পর্যন্ত সামরিক চাকরিতে ছিলেন।
নেতানিয়াহু যে সংঘাতকে ‘ইসরাইলের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয়‘ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন, তা কেবল তার জন্যই নয়, তার দেশের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় ছিল। এর আগ পর্যন্ত পশ্চিমতীর, পূর্ব জেরুসালেম ও গাজা যথাক্রমে জর্ডান ও মিসরের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সংশোধনবাদীরা এ অঞ্চলগুলোকে বৃহত্তর ইসরাইলের অংশ হিসেবে দেখত। ইসরাইল ১৯৬৭ সালে সিনাইয়ের সাথে সাথে এ অঞ্চলগুলোও দখল করে নেয়।
যুদ্ধের পরে পশ্চিমতীর, গাজা, সিনাই ও পূর্ব জেরুসালেমে ইহুদি বসতি নির্মাণ ত্বরান্বিত হয়, যদিও আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে এটি অবৈধ ছিল। এটি ইসরাইলে একটি নেতৃস্থানীয় ডানপন্থী আন্দোলনে পরিণত হয়, যা এখনো বিদ্যমান। এর সমর্থকরা এই অঞ্চলগুলোকে বাইবেলের গ্রন্থে প্রতিশ্রুত বৃহত্তর ইসরাইলের অংশ হিসেবে দেখে।
পশ্চিম তীরের জন্য ইসরাইলি জাতীয়তাবাদী শব্দটি ব্যবহার করে কংগ্রেসে ২০১১ সালে নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রকে বলেন, ‘জুডিয়া ও সামেরিয়ায় ইহুদিরা বিদেশী দখলদার নয়।’ তিনি সে সময় বলেন, ‘আমরা ভারতে ব্রিটিশ নই। আমরা কঙ্গোতে বেলজিয়ান নই। এটি আমাদের পূর্বপুরুষদের ভূমি, ইসরাইলের ভূমি, যেখানে আব্রাহাম এক ঈশ্বরের ধারণা নিয়ে এসেছিলেন, যেখানে দাউদ গোলিয়াথের মুখোমুখি হতে বেরিয়েছিলেন এবং যেখানে ইশাইয়া চিরস্থায়ী শান্তির দর্শন দেখেছিলেন।’
১৯৭৬ সালের জুনের শেষের দিকে, তেল আবিব ও প্যারিসে চলাচলকারী এয়ার ফ্রান্সের একটি বিমান পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অফ প্যালেস্টাইনের এক্সটার্নাল অপারেশনস হাইজ্যাক করেছিল। তারা ইসরাইল ও অন্যান্য স্থানে আটক ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের মুক্তির দাবি করেছিল। বন্দীদের সফলভাবে মুক্ত করার জন্য এন্তেবে বিমানবন্দরে আক্রমণের নেতৃত্বে ছিলেন ইয়োনি নেতানিয়াহু। তিনি অভিযানের সময় নিহত হন। নেতানিয়াহু ২০১৬ সালে বলেন, ইয়োনির মৃত্যু তার সবকিছু বদলে দিয়েছে। এমনকি ভাইয়ের মৃত্যুতে ‘তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা‘ হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন।
বেন নিতাই: মার্কিন মুক্তবাজার
পরবর্তী কয়েক বছরে নেতানিয়াহু জাতীয় যুদ্ধের পরিবর্তে সন্ত্রাসবাদ ও আরব বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সহিংসতার হুমকির বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেন। ইসরাইলে তিনি ইয়োনাটান নেতানিয়াহু সন্ত্রাসবিরোধী ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন।
এ সময় তিনি বোস্টনের এমআইটিতে পড়াশোনা শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালীন নেতানিয়াহু তার নাম পরিবর্তন করে ‘বেনিয়ামিন নিতাই‘ রাখেন, যা স্পষ্টতই ইসরাইলের মাউন্ট নিতাইয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে। তার বাবাও এই ছদ্মনামে লিখতেন।
যদিও নেতানিয়াহু বলেছিলেন, মার্কিনদের জন্য তার হিব্রু নাম সহজ উচ্চারণ করার জন্য নিজের নাম পরিবর্তন করেছেন। কিন্তু ইসরাইলি রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা পরে বলেছিলেন, তার নাম পরিবর্তন এটাই ইঙ্গিত করে যে তিনি দেশে ফিরে যাওয়ার চেয়ে দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রে থাকতে চান। এটি ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে এই ধারণাটিকে আরো স্পষ্ট করে তোলে যে নেতানিয়াহুর একটি অন্ধকার অতীত রয়েছে।
১৯৭৬ সালের গ্রীষ্মে তার ভাইয়ের মৃত্যুর মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে, নেতানিয়াহু বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের (বিসিজি) অর্থনৈতিক পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেখানে তিনি তার কট্টর মুক্ত-বাজার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলেন এবং ইসরাইলে লেবার পার্টি সমর্থিত রাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন সামাজিক গণতন্ত্রের একজন তীব্র বিরোধী হয়ে ওঠেন।
কয়েক দশক পরে ক্ষমতায় আসার পর নেতানিয়াহু ইসরাইলি অর্থনীতির মধ্যে ব্যাপক বেসরকারিকরণ তত্ত্বাবধান করেন। তিনি শক্তিশালী হিস্টাড্রুট ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃত্বকে ‘বলশেভিক ডাইনোসর‘ বলে উপহাস করেন, বৈদেশিক মুদ্রার নিয়মকানুন বাতিল করেন এবং ইসরাইলকে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে তুলে ধরেন।
‘বেন নিতাই‘ ১৯৭৮ সালে বোস্টনে অবস্থিত একটি টিভি বিতর্ক অনুষ্ঠান ‘দ্য অ্যাডভোকেটে’ উপস্থিত হন। সেখানে তিনি যুক্তি দেন, মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার মূল কারণ ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাব নয় বরং আরব রাষ্ট্রগুলোর ইসরাইলকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি।
তিনি সে সময় বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি আমাদের বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করা উচিত। যদি আমাকে লড়াই করতে হয়, আমি আবার লড়াই করব। তবে আমি লড়াইয়ের আশা করি না।‘
রাষ্ট্রদূত নেতানিয়াহু: ক্ষমতার দালাল
নেতানিয়াহু ১৯৮০ সালের মধ্যে ইসরাইলে ফিরে এলেও রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। সে সময় তিনি রিম ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি আসবাবপত্র কোম্পানির প্রচারণায় কাজ করেন। দুই বছর পর তার জীবন বদলে যায়।
ইসরাইলের প্রধান ডানপন্থী রাজনৈতিক দল লিকুদের রাজনীতিবিদ মোশে আরেন্স নেতানিয়াহুর একজন পারিবারিক বন্ধু ছিলেন। ওয়াশিংটনে ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর আরেন্সের একজন ডেপুটির প্রয়োজন ছিল। ১৯৮২ সালে নেতানিয়াহু রাজি হন।
সে সময় আন্তর্জাতিকভাবে ইসরাইল তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। সেই গ্রীষ্মে ইসরাইল পিএলও ধ্বংস করার জন্য লেবাননে আক্রমণ করে হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করে। সবচেয়ে কুখ্যাত গণহত্যা ছিল বৈরুতের সাবরা ও শাতিলা ক্যাম্পে। সেখানে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর সমর্থিত খ্রিস্টান মিলিশিয়া আনুমানিক ৩৫০০ ফিলিস্তিনি ও লেবাননের পুরুষ, নারীসহ শিশুকে হত্যা করা হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রে তার নতুন ভূমিকায় নেতানিয়াহু মিডিয়ার মাধ্যমে কাজ করেছিলেন এবং শীঘ্রই সংবাদ অনুষ্ঠানে নিয়মিত মুখ হয়ে ওঠেন। ১৯৮৪ সালে নেতানিয়াহুর সাফল্যের ফলে ৩৫ বছর বয়সে তাকে জাতিসঙ্ঘে ইসরাইলি রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
১৯৮৪ সালের নভেম্বরে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে এক উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের সময় জর্ডানের রাষ্ট্রদূত খালিদ মাদাদা পশ্চিমতীরে ইসরাইলের সামরিক শাসনকে নাৎসিদের শাসনের সাথে তুলনা করেছিলেন। নেতানিয়াহু তখন নিজেকে হলোকাস্টে নিহত ছয় মিলিয়ন ইহুদির মুখপাত্র হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
১৯৮৪ সালের ডিসেম্বরে ৩৫ বছর বয়সে নেতানিয়াহু একটি সাক্ষাৎকার দেন, যেখানে তিনি উল্লেখ করেন, তিনি জাতিসঙ্ঘের সবচেয়ে কম বয়সী প্রতিনিধিদের একজন।
তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ইসরাইল কি জাতিসঙ্ঘ ত্যাগ করার কথা বিবেচনা করবে, যদি এর বেশিভাগ অংশ ইসরায়েল-বিরোধী হয়? তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক দেশগুলো এবং তাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় যুক্তরাষ্ট্র জাতিসঙ্ঘে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, ততক্ষণ পর্যন্ত ইসরাইলের জাতীয় স্বার্থের জন্য এই ফোরামের অংশ হওয়া গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যাবশ্যক।’
তিনি ইসরাইল ও বৃহত্তর বিশ্বের জন্য ‘সন্ত্রাসবাদ‘ যে অস্তিত্বগত হুমকি তৈরি করেছে সে সম্পর্কেও তার চিন্তাভাবনা পুনরাবৃত্তি করেন। তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো এটা বোঝা যে এটি যুদ্ধের একটি রূপ এবং সেই অনুযায়ী আচরণ করা। এটি এমন একটি যুদ্ধ, যেখানে সন্ত্রাসী গণতান্ত্রিক সমাজকে ধ্বংস করতে চায়। সে ছাড়ে আগ্রহী নয় বরং আত্মসমর্পণে আগ্রহী। অতএব সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রথম নিয়ম হলো আত্মসমর্পণ করা নয়।‘
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু: ইসরাইলি রাজনীতিবিদ
নেতানিয়াহু ১৯৮৮ সালে ইসরাইলে ফিরে এসে ডানপন্থী লিকুদ পার্টিতে যোগ দেন এবং নেসেটে নির্বাচিত হন। অনেক ডানপন্থী আইন প্রণেতার মতো তিনিও ইসরাইলি সেনাবাহিনীতে কাজ করেছিলেন এবং জাতির ভাগ্য সম্পর্কে দৃঢ় ইহুদিবাদী বিশ্বাস পোষণ করতেন।
লেবানন দখল ও সাবরা, শাতিলা গণহত্যায় জড়িত থাকার জন্য ইসরাইল এখনো আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক নিন্দার সম্মুখীন। এর মধ্যে ইহুদি প্রবাসী ও বামপন্থী ইসরাইলিরাও অন্তর্ভুক্ত।
১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী ও লিকুদ নেতা ইতজাক শামিরকে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের রিপাবলিকান হোয়াইট হাউস মাদ্রিদ সম্মেলনে পিএলওর সাথে আলোচনার জন্য চাপ দেয়। ফলে ১৯৯৩ এবং ১৯৯৫ সালের অসলো চুক্তি হয়।
শামির ও তার বৃহত্তর ইসরাইলের আকাঙ্ক্ষা বাকি ইসরাইল ও বিশ্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। ১৯৯৩ সালে লিকুদ ক্ষমতা হারায়, শামির নেতৃত্ব হারান এবং নেতানিয়াহু দলের নেতা হন।
শুরু থেকেই নেতানিয়াহু শান্তি আলোচনা, দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন।
অসলো চুক্তি স্বাক্ষর, দেশটির প্রধানমন্ত্রীর হত্যা ও আলোচনার পক্ষে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে লেবার পার্টির আকস্মিক পরাজয়ের পর ইসরাইল তার ভবিষ্যৎ নিয়ে আরো বিভক্ত হয়ে পড়ে। গত তিন দশকে এই বিভেদ আরো বিস্তৃত হয়েছে। কারণ ইসরাইলে জনপ্রিয় মনোভাব আরো বেশি করে ডানপন্থী, জেভ জাবোটিনস্কি ও বেনজিয়ন নেতানিয়াহুর সংশোধনবাদী ইহুদিবাদের দিকে সরে গেছে।
একই সময়ে নেতানিয়াহু তার ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছেন এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন। ১৯৯৬ সালে নেতানিয়াহু প্রথম ক্ষমতা গ্রহণের আগে পাঁচ দশকে ইসরাইলের সাতজন লেবার নেতা ছিলেন।
গত ১৫ মাস ধরে নেতানিয়াহু গাজায় বারবার সামরিক আক্রমণ পরিচালনা করেছেন। অবৈধ ইহুদি বসতি আগের চেয়েও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত করেছেন। ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা ও মানবাধিকার বারবার চূর্ণবিচূর্ণ করা হয়েছে। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের সম্ভাবনা এখনো আরো দূরবর্তী। নেতানিয়াহুর প্রতিটি নীতি ও বিবৃতি ইসরাইলের পক্ষ থেকে যেকোনো ধরনের আপসের বিরোধিতা করেছে।
তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের পাশাপাশি অভিযোগ রয়েছে যে তিনি নিজেকে জেল থেকে বাঁচাতে বিচার বিভাগকে দুর্বল করেছেন।
ব্যাপক ও বিশাল বিক্ষোভ সত্ত্বেও নেতানিয়াহু কখনো পিছু হটেননি। গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় তিনি ইসরাইলি পণবন্দীদের মুক্ত করতে আলোচনার পরিবর্তে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে আক্রমণ বেছে নেন। তার এ সিদ্ধান্ত দেশে অনেকের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেয়।
নেতানিয়াহুর শেষ দিনগুলো সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী, তা সে রাজনীতিবিদ বা নাগরিক হিসেবেই হোক না কেন, বারবার করা হয়েছে এবং সর্বদাই তা অকাল প্রমাণিত হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার সাথে সাথে ওয়াশিংটনে প্রশাসনের পরিবর্তন হয়েছে এবং তার পূর্বসূরী জো বাইডেনের চেয়ে নেতানিয়াহুর প্রতি আরো সহানুভূতিশীল প্রমাণিত হয়েছে।
কিন্তু যখন শেষ সময় আসবে, তখন নেতানিয়াহুকে কিভাবে স্মরণ করা হবে?
এর উত্তরে সাবেক মধ্যপ্রাচ্য দূত অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, ‘ইসরাইলি রাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী। এবং কোনো দ্বিধা বা আপত্তি ছাড়াই সবচেয়ে খারাপ প্রধানমন্ত্রী।‘