যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রথমবারের বৈঠকে কী চায় হামাস

যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রথমবারের বৈঠকে কী চায় হামাস
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রথমবারের বৈঠকে কী চায় হামাস | ছবি : সিএনএন

গত ১৭ মাস ধরে চলছে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাত। এর রাজনৈতিক কোনো সমাধান হচ্ছে না। ফলে হাজার হাজার

মানুষ মারা যাচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মনে করেন যে হামাসের সদস্যরা অসুস্থ। এদিকে, ইসরাইলের

প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মনে করেন, এই ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করার জন্য হামাসকে নির্মূল করতে হবে। চলমান

যুদ্ধে তিনি গর্ব করে বলেন, ওই লক্ষ্য অনেকটা ঘনিয়ে এসেছে।

তবে বুধবার দেখা গেছে যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়তো বাস্তবেই বিষয়টির একটা সুরাহা করবেন। এর প্রমাণ হলো,

মার্কিন সরকার কখনো তালিকাভুক্ত উগ্রবাদী সংগঠনের সাথে বৈঠক করে না। কিন্তু ওই রীতি ভঙ্গ করে সরকার এবার

হামাসের সাথে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে।

হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লিভিট বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘মার্কিন বিশেষ দূতের এই ধরনের

সংলাপের অধিকার আছে। সেজন্য এ ধরনের সংলাপ হতে পারে।’

ট্রাম্প ইতোপূর্বে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদেরকে বের করে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি উপত্যকাটির নিয়ন্ত্রণ নিতে চান।

এর বাইরে হয়তো তিনি চাচ্ছেন, হামাসের হাতে বন্দী অবশিষ্ট ইসরাইলিদেরকে মুক্ত করার জন্য তিনি হামাসের কথা

শুনতে চান। এছাড়া এখনো হামাসের হাতে বন্দী রয়েছেন একজন মার্কিন নাগরিক এডান আলেকজান্ডার। এর বাইরে

আরো চার মার্কিনীর লাশ হামাসের হেফাজতে আছে। এই বৈঠকটি ব্যতিক্রম। এর আগের আলোচনাগুলো কাতার ও

মিসরের মধ্যস্থতায় অনুষ্ঠিত হয়েছে।

হামাস ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইসরায়েলি রাষ্ট্রকে প্রতিরোধ করার জন্য তারা

নিবেদিতপ্রাণ। তারা দীর্ঘদিন ইসরাইলের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছিল। তবে ২০১৭ সালে বলেছিল যে তারা গাজা,

পশ্চিমতীর এবং পূর্ব জেরুজালেম নিয়ে একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠন করতে প্রস্তুত। জর্ডান, মিসর এবং সিরিয়া থেকে

বিশাল অঞ্চল দখল করার আগে যে সীমানা বিদ্যমান ছিল, ওই সীমানায় তারা দেশ গড়তে চায়।

আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে গাজা, পশ্চিমতীর ও পূর্ব জেরুজালেমকে ইসরাইলের সামরিক দখলদারিত্বের অধীন বিবেচনা করা হয়। গাজার উপর ইসরাইলের ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের একটি মৌলিক লক্ষ্য ছিল হামাসকে ক্ষমতা

থেকে সরিয়ে দেয়া এবং ইসরাইলের জন্য যেন তারা পরবর্তীতে আর হুমকি না হতে পারে, সেটি নিশ্চিত করা।

অন্তত প্রথম বিষয়টি সম্ভব বলে মনে হয়। এটি হামাসের নানা নেতার বক্তব্য থেকে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এর মধ্যে গত মাসে আল আরাবিয়াকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে হামাসের মুখপাত্র হাজেম কাসেমের একটি বক্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, আমরা স্পষ্টভাবে বলছি যে পরবর্তী পর্যায়ে রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক ব্যবস্থার অংশ হওয়া হামাসের জন্য প্রয়োজনীয় নয়।’

হামাসের আরেক মুখপাত্র আবু জুহরি সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, হামাস অস্ত্র সমর্পণ করবে, এমন ধারণা করা ঠিক নয়।

এদিক, নেতানিয়াহুর জন্য ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র মেনে নেয়ার প্রস্তাব কঠিন হবে। কারণ, তিনি মনে করেন, যদি হামাসকে অস্ত্র সমর্পণে বাধ্য করা যায়, তাহলে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতের অর্থপূর্ণ রাজনৈতিক নিষ্পত্তি সম্ভব হবে। অথচ এটি একদমই অকল্পনীয়। কারণ, আন্তর্জাতিক নিয়মানুসারে যেকোনো অধিকৃত ভূমির নাগরিকের আত্মরক্ষার অধিকার আছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, হামাস এ বিষয়ে সচেতন যে কোনো রাষ্ট্র যখন বিশেষ শর্তারোপ করে, তখন তা যথাযথভাবে মেনে চলতে হয়। তাই সৌদি আরবের মতো আন্তর্জাতিক শক্তির সমর্থন পেতে ইসরাইলকে অবশ্যই তাদের কূটনৈতিক সমঝোতা মানতে হবে। আর সৌদি আরব এক্ষেত্রে দ্ব্যর্থহীন যে ইসরাইলের সাথে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।

তবে নেতানিয়াহু যদিও চলমান যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের পক্ষে কিছুটা নমিত ছিলেন, কিন্তু চলমান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি ওই সমাধানে যেতে মোটেই রাজি নন। নেতানিয়াহু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র যদি হয়, তাহলে সেটা হামাসের জন্য হবে পুরস্কার। সেজন্যই তিনি গাজার ২১ লাখ ফিলিস্তিনিকে বাস্তুচ্যুত করার ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে সমর্থন করেছেন আর তার অতি-ডানপন্থী জোটের অংশীদাররা উপত্যকায় ইহুদি বসতি পুনঃস্থাপনের পরিকল্পনা প্রস্তুত করছে।

ট্রাম্প বারবার প্রমাণ করেছেন, তিনি যদি মনে করেন যে এটি তার জন্য উপকারী হবে, তবে তিনি দীর্ঘদিনের

আমেরিকান মিত্রদের অস্বস্তিকর অবস্থানেও বাধ্য করতে ইচ্ছুক।

তার প্রশাসন আফগানিস্তান থেকে পশ্চিমা বাহিনী প্রত্যাহারের জন্য তালেবানের সাথে আলোচনা করেছে, যার ফলে

শেষ পর্যন্ত দীর্ঘদিনের আমেরিকান-সমর্থিত প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সরকার উৎখাত হয়েছে।

ইসরাইলের নেতারা স্পষ্টতই হামাসের সাথে ট্রাম্প কী আলোচনা করতে পারেন, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। যখন প্রকাশ পেল যে

আমেরিকা হামাসের সাথে কথা বলছে, তখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি প্রকাশ করে যে ‘ইসরাইল

হামাসের সাথে সরাসরি আলোচনার বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তার অবস্থান প্রকাশ করেছে’- সেই অবস্থান কী

তা উল্লেখ না করে। এখন প্রশ্ন হলো ট্রাম্প কতদূর যেতে ইচ্ছুক।

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক বাসকিন বলেন, ‘হামাসের উপর আমেরিকার বলতে গেলে কোনো প্রভাবই নেই। হামাসের বিরুদ্ধে মার্কিন হুমকি প্রায় অকেজো। আমেরিকা গাজায় বোমা হামলা চালানো বা সেখানে মার্কিন উপস্থিতিরির সম্ভাবনা নেই।’

তার মতে, প্রধান বিপদ হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘মানবিক সরবরাহ বন্ধ করার মতো আন্তর্জাতিক আইনের আরো লঙ্ঘন’

করার জন্য সবুজ সংকেত দেবে। ইসরাইল গাজায় আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের কথা অস্বীকার করে।

‘এদিকে, যুদ্ধ শেষ না হলে এবং ইসরাইল গাজা ছেড়ে না গেলে কোনো চুক্তি হবে না। সব বন্দীকে মুক্ত না করেও যুদ্ধের কোনো শেষ হয় না। হামাস যদি সামরিক বা রাজনৈতিকভাবে গাজা নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে, তবে যুদ্ধটাও স্থায়ীভাবে আসল শেষ হবে না।’

ট্রাম্প হয়তো হামাসের নেতৃত্বকে বলবেন, ‘এখন গাজা ছেড়ে যাওয়ার সময়। কিন্তু তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টারা

অবশ্যই তাকে বলবেন যে আমেরিকা বিশ্বাস করে যে উগ্রবাদী গোষ্ঠীটি ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়াই করে যতজন সদস্য

হারিয়েছে, তার চেয়ে বেশি সদস্য নিয়োগ করেছে।

হামাসের পলিট ব্যুরোর একজন সিনিয়র সদস্য ওসামা হামদান সম্প্রতি বলেছেন, এই গোষ্ঠীর ‘সম্প্রসারণের সুযোগ’

রয়েছে। ইসরাইলের নির্দেশ পালন করতে গাজায় আসা যেকোনো বহিরাগত ব্যক্তিকে ‘ইসরাইলের মতো আচরণ করা হবে।’

ইসরাইলের নতুন সামরিক প্রধান এই সপ্তাহে সতর্ক করে বলেছেন, দেশকে ‘দীর্ঘস্থায়ী বহু-ফ্রন্ট যুদ্ধের’ জন্য

প্রস্তুত থাকতে হবে।

একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনি নিজেকে শান্তিরক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করেন, তার পক্ষে এটি ভালো হবে না।

বাসকিন বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছি যে আমরা সবাই এখনো গভীর মানসিক আঘাতের মধ্যে আছি। আমি বুঝতে পারছি যে আজ বেশিরভাগ ইসরাইলি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ধারণা স্বীকার করে না। কিন্তু (জর্ডান) নদী এবং (ভূমধ্যসাগর) সাগরের মাঝামাঝি ভূমিতে বসবাসকারী ৭০ লক্ষেরও বেশি ইসরাইলি ইহুদি এবং ৭০ লক্ষেরও বেশি ফিলিস্তিনি আরবের বাস্তবতা ইসরাইলি জনমতের বর্তমান মনোভাবের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ।’

সূত্র : সিএনএন