ফিলিস্তিনপন্থী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া সেই যুবক এখন বিপাকে

আমি তাকে ঘরে ফিরিয়ে আনতে চাই। আমার প্রথম সন্তান যখন পৃথিবীতে আসবে, তখন আমার স্বামীকে আমি পাশে চাই। এজন্য সবার সহযোগিতা চাই।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
13.03.25
মাহমুদ খলিল | ইউএনবি

গত বসন্তে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গাজায় ইসরাইলি সহিংসতা বন্ধে বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়, যা পরবর্তীতে দেশটির অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় নির্ভীক চাহনির এক ফিলিস্তিনি যুবকের মুখ বেশ পরিচিত হয়ে ওঠে। দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমে আন্দোলনের সংবাদে দেখা যায় ওই যুবকের দীপ্ত চেহারা।

সম্প্রতি আবার আলোচনায় ফিরেছে সেই চেহারা। কারণ তখনকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার ‘অপরাধে’ তাকে এবার আইনের আওতায় আনা হয়েছে।

ওই যুবকের নাম মাহমুদ খলিল। তিনি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ বিষয়ের শিক্ষার্থী। যে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় গাজায় নির্বিচারে বোমা বর্ষণ করেছিল ইসরাইল, সেই যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতেই উপক্যতাটিতে হামলা বন্ধে গত এপ্রিলের সংঘঠিত তীব্র আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক এই যুবক।

যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সেরা আটটি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গঠিত গ্রুপ ‘আইভি লীগের’ একটি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অভিবাসী শিক্ষার্থী হিসেবে খলিলের এই সাহসিকতা বাস্তবিকই প্রশংসার দাবিদার বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে। আবার অনেক সমালোচকদের লক্ষ্যবস্তুও হয়েছে তার এই কর্মকাণ্ড।

খলিল কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানহ্যাটন ক্যাম্পাসের আন্দোলনে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। পাশাপাশি তিনি যুদ্ধে ইসরাইলকে সমর্থনকারী কোম্পানিগুলোর সাথে এই ‘আইভি লীগ’ বিশ্ববিদ্যালয়টির আর্থিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবিতে আন্দোলনরতদের মুখপাত্র ও আলোচকের ভূমিকা পালন করেন।

আন্দোলন চলাকালে খলিল বলেছিলেন, ‘আমরা সবার নজর কাড়তে চাই।’

খলিল সত্যিই যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের নজর কেড়েছিলেন, যার ফলস্বরূপ শনিবার (৮ মার্চ) দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তথাকথিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ইহুদিবিদ্বেষী বিক্ষোভ বন্ধের অভিযানের প্রথম শিকার ৩০ বছর বয়সী এই ফিলিস্তিনি যুবক।

মাহমুদ খলিলের মতো একজন সাধারণ শিক্ষার্থীর চেহারা বোধহয় দেশটির প্রশাসনের বুকে শেলের মতোই বিঁধেছিল। এ কারণেই গ্রিনকার্ডধারী স্থায়ী বাসিন্দা এবং এক মার্কিনকে বিয়ে করার পরও তাকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করতে উঠেপড়ে লেগেছে ট্রাম্প প্রশাসন।

গত শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসভবন থেকে খলিলকে গ্রেফতার করে যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্টের (আইসিই) কর্মকর্তারা। বর্তমানে তাকে লুইজিয়ানার জেনায় একটি অভিবাসী আটককেন্দ্রে রাখা হয়েছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের মতে, খলিলকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে ইহুদি শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যাম্পাসে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করায় অভিযুক্ত বিদেশী শিক্ষার্থীদের দেশ থেকে বের করে দেয়ার অভিযানের শুরু হয়েছে।

তবে ওয়াশিংটনের এই পদক্ষেপকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় আঘাত ও ফিলিস্তিনপন্থী মতামত দমনের চেষ্টা বলে অভিহিত করেছেন অনেক মানবাধিকার কর্মী ও খলিলের আইনজীবীরা।

খলিলের গ্রেফতারের খবরে মর্মাহত হয়েছেন আন্দোলন চলাকালে তার সহকর্মীরাও। তারা জানায়, খলিল তার কূটনৈতিক জ্ঞানের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বিক্ষোভের উতপ্ত দিনগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে মধ্যস্ততার চেষ্টা করেছেন।

অ্যান্ড্রু ওয়ালার নামে খলিলের এক সহকর্মী বলেন, ‘তিনি (খলিল) ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সিরিয়ার সাথে যু্ক্তরাজ্যের কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করেছেন। সিরিয়াতে একটি বৃত্তির ফান্ডও পরিচালনা করেছিলেন খলিল।’

এ ধরনের দায়িত্ব দেয়ার আগে নিশ্চয়ই খলিলের অতীত নিয়ে পর্যাপ্ত অনুসন্ধান করা হয়েছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ওয়ালার আরো জানান, ‘খলিলের স্ত্রী গর্ভবতী, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পৃথিবীতে আসতে চলেছে তাদের প্রথম সন্তান।’

গত সপ্তাহে খলিলের সাথে তার আলাপ হয়েছে উল্লেখ করে ওয়ালার বলেন, ‘ট্রাম্প প্রশাসনের নিশানা হওয়ার আশঙ্কা তিনি (খলিল) আগেই করেছিলেন।’

যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে

সিরিয়ায় একটি ফিলিস্তিনি পরিবারে খলিলের জন্ম। সেখানেই উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেন তিনি। এভিয়েশন ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন এই যুব্ক, কিন্তু তার স্বপ্নে বাধ সাধে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ।

২০১৭ সালে একটি আন্তর্জাতিক শিক্ষা সহায়তায় খলিলের দেয়া এক নিবন্ধ থেকে জানা গেছে, সিরিয়া থেকে পালিয়ে গিয়ে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে শিশুশিক্ষা নিয়ে কাজ করে-এমন একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজে যোগ দেন তিনি। পরে লেবাননের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক সম্পন্ন করে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন খলিল।

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় গাজায় যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভের সময়ে তিনি মার্কিন প্রশাসনসহ সমালোচকদের নজরে আসেন।

শিক্ষার্থী বিক্ষোভকারীদের মধ্যে কেউ কেউ গত বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় তাঁবু স্থাপন করেছিলেন। কয়েক ঘণ্টার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি একাডেমিক ভবনের নিয়ন্ত্রণও নিয়েছিলেন তারা। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের হটাতে পুলিশের শরণাপন্ন হয়।

বিক্ষোভ চলাকালে ফিলিস্তিনি সমর্থক ও নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত মুসলিম শিক্ষার্থীদের পক্ষে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেন খলিল। এরপর বিক্ষোভের মধ্যে উঁচু স্বরে প্রতিবাদ জানানোর ফলে দ্রুতই নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন তিনি। এই আন্দোলনকে যারা ইহুদীবিদ্বেষী হিসেবে দেখেছিলেন, তিনি তাদের চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন।

গত সপ্তাহে অ্যাসোসিয়েট প্রেসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে খলিল বলেন, ‘এই ফিলিস্তিনির দিকে তাকান, যে কখনো নিজের মুখ লুকায়নি-বলে আমাকে আসলে ফাঁসানো হয়েছে।’

অন্যদিকে, খলিলকে ক্যাম্পাসে ‘অরাজকতার হোতা’ হিসেবে বলে আখ্যা দিয়েছে কলাম্বিয়া ইহুদি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন। এছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি শৃঙ্খলা কমিটি তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তদন্ত করছে।

সর্বশেষ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ডিনকে ‘নরহত্যাকারী’ বলে সম্বোধন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি ভঙ্গ করেছেন।

ট্রাম্প প্রশাসনের নিশানায় খলিল

ট্রাম্প গত ২০ জানুয়ারি দ্বিতীয় দফায় হোয়াইট হাউসে ফিরেই অঙ্গীকার করেছিলেন, গত বছর কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনপন্থী আন্দোলনে জড়িত কিছু বিদেশী শিক্ষার্থীকে তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেবেন। এই আন্দোলনকে তিনি ‘ইহুদিবিদ্বষী’ বলে অভিহিত করেন।

ট্রাম্পের মতে, গাজার ক্ষমতায় থাকা ‘সন্ত্রাসী সংগঠন হামাসকে’ সমর্থন করে ওই শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রে থাকার অধিকার হারিয়েছেন।

ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশেই মাহমুদ খলিলকে শনিবার গ্রেফতার করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন অভিবাসন কর্মকর্তারা।

শনিবার আটকের পর খলিলকে লুইজিয়ানার একটি অভিবাসী আটককেন্দ্রে রাখা হয়েছে। সেখানে তিনি পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন।

এ ঘটনার পর রোববার (৯ মার্চ) এক্সে দেয়া এক পোস্টে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, ‘আমেরিকায় হামাস সমর্থকদের ভিসা ও গ্রিনকার্ড বাতিল করবে প্রশাসন, যাতে তাদের নির্বাসন দেয়া যায়।’

পরে মঙ্গলবার (১১ মার্চ) সংবাদ সম্মেলনে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র ক্যারোলিন লেভিট বলেন, ‘মাহমুদ খলিলকে অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্র থেকে নির্বাসিত করা উচিত।’

লেভিটের ভাষ্যে, ‘খলিল এমন একটি বিক্ষোভ সংগঠিত করেছেন, যা শুধু কলেজ ক্যাম্পাসের শিক্ষা কার্যক্রমকে ব্যাহত করেনি, আমেরিকার ইহুদি শিক্ষার্থীদেরও হয়রানি করেছে। এছাড়া তাদের নিজ ক্যাম্পাসে নিরাপত্তাহীনতার পরিস্থিতি তৈরি করেছে বিক্ষোভকারীরা।’

হামাসের সমর্থনে খলিল প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েছে বলেও অভিযোগ করেন লেভিট। তবে লেভিটের এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তার সাথে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য শিক্ষার্থীরা।

ম্যারিয়ান আলওয়ান নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘অন্য কেউ বিক্ষোভ-সংশ্লিষ্ট নয়-এমন কিছু প্রচার করলে সেই দায় যাতে খলিলের ওপর না বর্তায়, এ কারণেই তিনি (খলিল) মুখ খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেন।’

এদিকে, খলিলের স্ত্রী আট মাসের গর্ভবতী বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবীরা। নিজের নাম না প্রকাশ করে এক বিবৃতিতে খলিলের স্ত্রী বলেন, ‘আমার চোখে মাহমুদ খলিল একজন স্নেহপরায়ণ স্বামী এবং আমার গর্ভের সন্তানের বাবা।’

খলিলকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিজের কাছে ফিরিয়ে নিতে তিনি সবার সহযোগিতা কামনা করেছেন।

তিনি আরো বলেন, ‘আমি তাকে ঘরে ফিরিয়ে আনতে চাই। আমার প্রথম সন্তান যখন পৃথিবীতে আসবে, তখন আমার স্বামীকে আমি পাশে চাই। এজন্য সবার সহযোগিতা চাই।’ সূত্র : ইউএনবি