১৪ শ’ বছরের মুসলিম স্থাপত্য
শাহজাদপুরের মখদুম শাহ দৌলার মাজার ও মসজিদ
ইয়েমেনের শাহাজাদা হজরত মখদুম শাহ দৌলা শহীদ ইয়েমেনী (রহ:)-এর নামানুসারেই এই স্থানের নামকরণ হয়েছে ‘শাহজাদপুর’।

আবুল কাশেম শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ)
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর পৌর শহরের দরগাপাড়ায় অবস্থিত হজরত মখদুম শাহ দৌলা শহীদ ইয়েমেনি (রহ:)-এর মসজিদ ও মাজার শরিফ। এ সম্পর্কে জানা যায়, ইয়েমেনের শাহাজাদা হজরত মখদুম শাহ দৌলা শহীদ ইয়েমেনী (রহ:)-এর নামানুসারেই এই স্থানের নামকরণ হয়েছে ‘শাহজাদপুর’।
কথিত আছে, হজরত মখদুম শাহ দৌলা শহীদ ইয়েমেনি (রহ:) ১১৯১-৯২ সালের কোনো একসময় আরবের দেশ ইয়েমেন থেকে শাহাজাদা জীবনের সুখ-শান্তিকে বিসর্জন দিয়ে ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে প্রথমে বোখারা শহরে পৌঁছান। সেখানকার বিখ্যাত ওলি হজরত জালাল উদ্দিন বোখারি (রহ:)-এর সাথে কিছু সময় কাটানোর পর যাত্রা শুরু করে বাংলার এ অঞ্চলে আসেন। যাত্রাকালে হজরত জালাল উদ্দিন বোখারি (রহ:) মখদুম শাহ দৌলার হাতে এক জোড়া কবুতর দিয়ে দেন, যা জালালি কবুতর নামে পরিচিত। এখনো ওই কবুতরের বংশধররা শাহজাদপুর মখদুমিয়া জামে মসজিদের উপরের কার্নিশের ধারে ধারে গর্ত করা নির্দিষ্ট স্থানে বসবাস করছে। মখদুম শাহ দৌলার বহনকারী জাহাজটি পানি পথে এ অঞ্চলে পৌঁছালেও দীর্ঘ সময় ভূমির সন্ধান পাচ্ছিল না। কথিত আছে, এভাবে জাহাজ চলতে চলতে কোনো একসময় জাহাজ পানির নিচে মাটিতে ধাক্কা খায় এবং মখদুম শাহ্ দৌলা সেখানেই জাহাজ নোঙরের সিদ্ধান্ত নেন। যে স্থানে নোঙর করার সিদ্ধান্ত নেন সেটির বর্তমান নাম ‘পোতাজিয়া’। ‘পোঁত’ অর্থ গাড়া আর ‘আওজিয়া’ অর্থ ভেরা, সে জন্য জাহাজ ভেরার স্থানটি এবং তার নোঙর পোঁতার স্থানটির নাম পোতাজিয়া। পোঁত আওজিয়া থেকে পোতাজিয়া।
পোতাজিয়া গ্রামটির নামানুসারে বর্তমানে ওই ইউনিয়নের নামও পোতাজিয়া ইউনিয়ন পরিষদ। হজরত মখদুম শাহ দৌলা সকালে উঠে আধ্যাত্মিক ভাবনায় মাটি ও মানুষের সন্ধানে সাথে থাকা কবুতর জোড়া ছেড়ে দেন। দিন শেষে কবুতরগুলো পায়ে কাদামাটিসহ জাহাজে ফিরে এলে তিনি বুঝতে পারেন এই অঞ্চলে মাটি ও মানুষের বসবাস আছে। এভাবে সন্ধান করে হযরত মখদুম শাহ্ দৌলা এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। তৎকালীন সুবা বিহারের অমুসলিম রাজা বিক্রম কিশোরী এ খবর পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ইসলাম প্রচার বন্ধ করতে তার সেনাবাহিনী পাঠান। কিন্তু সেই বাহিনী হজরত মখদুম শাহ দৌলা (রহ:)-এর সঙ্গী এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা নব্য মুসলমানদের সমন্বিত জনবলের কাছে বার বার পরাজিত হয়। এ ছাড়াও ইতোমধ্যেই মখদুম শাহ দৌলার আহ্বানে দলে দলে লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় এ অঞ্চল ইসলাম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত হয়। তবে শেষ যুদ্ধে এক চক্রান্তের কারণে মখদুম শাহ্ দৌলা পরাজিত হন এবং তিনি ও তার সাথীসহ বহু অনুসারী যোদ্ধা শহীদ হন। এই যুদ্ধে শহীদ হওয়ায় তিনি হজরত মখদুম শাহ দৌলা শহীদ ইয়েমেনি (রহ:) নামে পরিচিতি লাভ করেন। শেষ যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ হিসেবে কথিত আছে, পূর্ববর্তী যুদ্ধে পরাজিত এবং বন্দী সৈনিকদের মধ্যে একজন গুপ্তচর হিসেবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং মখদুম বাবার অত্যন্ত বিশ্বস্ততা অর্জন করেন।
শেষ যুদ্ধ চলাকালে আসরের নামাজ আদায়ের সময় সিজদারত অবস্থায় ওই গুপ্তচর হজরত মখদুম শাহ দৌলা ইয়েমেনি (রহ:)-এর মাথা কেটে তা হাতে নিয়ে সুবা-এ-বিহারের রাজধানী মঙ্গলকোর্ট মতান্তরে মহল কোর্টের রাজার কাছে হাজির করলে দেখা যায় তার কণ্ঠ থেকে অলৌকিকভাবে ‘সুবহানা-রাব্বি-আল-আলা’ উচ্চারিত হচ্ছে। তা দেখে রাজা ভয় পান এবং প্রধান সেনাপতি ও স্থানীয় মুসলিমদের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এ সময় রাজা স্থানীয় মুসলমানদের ডেকে হজরত মখদুম শাহ দৌলা শহীদ ইয়েমেনি (রহ:)-এর মস্তক সমাধিস্থ করার নির্দেশ দেন। যে স্থানে ওই মস্তক সমাহিত করা হয়েছে সেই স্থানাট ‘ছের মোকাম’ নামে আজও পরিচিত আছে। অন্য দিকে শাহজাদপুরে হজরত মখদুম শাহ দৌলা শহীদ ইয়েমেনি (রহ:)-এর লাশ পাথরের কফিনে করে বর্তমান মসজিদের দক্ষিণে দাফন করা হলেও নদীভাঙনের কারণে এক সময় বর্তমান স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়।
এরপর মখদুম শাহর সাথী হজরত ইউসুফ শাহ (রহ:) এ অঞ্চলের মুসলিম শাসনকর্তা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। সেই থেকে এ অঞ্চলের নাম ‘পরগণে ইউসুফ শাহী’ নামে পরিচিত। শাহজাদপুরে হজরত মখদুম শাহ দৌলা ইয়েমেনি (রহ:)-এর মাজার শরিফ ছাড়াও তার ভাগ্নে খাজা নুর (রহ:), হজরত ইউসুফ শাহ্ (রহ:) ও মখদুম শাহর ওস্তাদ বিখ্যাত ওলি হজরত শামসুদ্দিন তাবরেজি (রহ:)-এর মাজারও আছে। এই শামসুদ্দিন তাবরেজি (রহ:) ভারতের বিখ্যাত ওলি জালাল উদ্দিন রুমিরও (রহ:) ওস্তাদ ছিলেন। মখদুম শাহ্র মাজারের পূর্ব-দক্ষিণের কিছু দূরে করতোয়া নদীর ওপারে তার শিষ্য ও সাথী হজরত শাহ হাবিবুল্লাহ ইয়েমেনি (রহ:)-এর আরো একটি মাজার আছে। যেটি ‘বাদল বাড়ি’ নামে পরিচিত। কিংবদন্তি থেকে আরো জানা যায়, শাহজাদপুরে আরো কয়েকজন ওলির মাজার ছিল, যা পাশের হুড়াসাগর নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। মখদুম শাহর মাজারের পাশেই আছে বাংলার সুলতানী আমলে মুসলিম স্থাপত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি মসজিদ, যা হজরত মখদুম শাহ দৌলা শহীদ ইয়েমেনির (রহ:) নির্দেশে নির্মিত হয়। ইট-চুন-সুরকি দিয়ে তৈরি এই মসজিদটির পাঁচটি দরজা ও ১৫টি গম্বুজ আছে। মসজিদটি ২৪টি কালো পাথরের স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদটির নাম ‘মখদুমিয়া জামে মসজিদ’।
বাংলাদেশের যেকোনো অঞ্চল থেকে ট্রেনযোগে এলে পার্শ্ববর্তী উপজেলা উল্লাপাড়ায় নেমে বাস বা অটোরিকশায় আধঘণ্টায় শাহজাদপুরে আসা যায়। তা ছাড়া দেশের প্রায় সবগুলো জেলা থেকেই বাসযোগে শাহজাদপুরে আসার সহজ সুযোগ আছে।