পুঁজিবাজারে অস্থির সপ্তাহ : সূচকের পতন, কমিশনে বিশৃঙ্খলা

দেশের পুঁজিবাজারের জন্য গত সপ্তাহ মোটেও সুখকর ছিল না। একদিকে সূচকের পতন আর লেনদেন কমে যাওয়া, অন্যদিকে বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থায় অভ্যন্তরীণ কোন্দল। সব মিলিয়ে অস্থিরতা কাটছে না পুঁজিবাজারে।

stock exchange
পুঁজিবাজারে সূচকের পতন

দেশের পুঁজিবাজারের জন্য গত সপ্তাহ মোটেও সুখকর ছিল না। একদিকে সূচকের পতন আর লেনদেন কমে যাওয়া, অন্যদিকে বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থায় অভ্যন্তরীণ কোন্দল। সব মিলিয়ে অস্থিরতা কাটছে না পুঁজিবাজারে।

গত পাঁচ কার্যদিবসে টানা তিন দিন পতনের পর শেষ দুই দিন সূচকের উত্থান হলেও সামগ্রিকভাবে সূচক ছিল কমতির দিকে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ৪৩ পয়েন্ট।

২ মার্চ পাঁচ হাজার ২৪৭ পয়েন্ট দিয়ে শুরু হওয়া লেনদেন ৬ মার্চ শেষবেলায় গিয়ে ঠেকেছে পাঁচ হাজার ২০৩ পয়েন্টে। অন্যদিকে বাছাইকৃত শেয়ারের ব্লু-চিপ সূচক ডিএস-৩০ কমেছে ১৫ পয়েন্ট।

একই অবস্থা শরীয়াভিত্তিক সূচকেও। পাঁচ দিনে ডিএসইএসের সূচক কমেছে ছয় পয়েন্ট। বেহাল দশা ক্ষুদ্র এবং মধ্যম আকারের কোম্পানি নিয়ে গঠিত এসএমই সূচকে। এক সপ্তাহের লাগাতার পতনে এসএমই সূচক নেমে এসেছে এক হাজার পয়েন্টের নিচে।

এক হাজার ১৭ পয়েন্ট থেকে ডিএমএমএএক্স ৪৭ পয়েন্ট কমে ৯৭০ পয়েন্টে নেমে এসেছে, যা এর আগের সপ্তাহের তুলনায় চারদ দশমিক ৬৫ শতাংশ কম।

পুরো সপ্তাহে লেনদেনে অংশ নেয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই ছিল দরপতনের তালিকায়। ২৮৯ কোম্পানির দরপতনের বিপরীতে দাম বেড়েছে মাত্র ৮৬ কোম্পানির এবং অপরিবর্তিত আছে ২০ কোম্পানির শেয়ারের দাম।

এক সপ্তাহের ব্যবধানে ঢাকার পুঁজিবাজারে লেনদেন কমেছে ২৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ। পাঁচ শ’ কোটি টাকার ওপরে হওয়া গড় লেনদেনে পাঁচ কার্যদিবসে নেমে এসেছে তিন শ’ কোটির ঘরে। লেনদেন কমার পাশাপাশি ঢাকার বাজারে মূলধন কমেছে এক দশমিক ৯০ শতাংশ।

পুরো সপ্তাহেজুড়ে মাত্র তিন খাতে শেয়ারের দাম বেড়েছে। জ্বালানি, কাগজ এবং চামড়া খাত ছাড়া বড় বড় সবকয়টি খাতে হয়েছে বড় দরপতন। এর মধ্যে ব্যাংক খাতে শেয়ারের দাম কমেছে ২৭ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং এ খাতে শেয়ার লেনদেনের পরিমাণ কমেছে ৩১ দশমিক ৯১ শতাংশ। তালিকাভুক্ত ৩৬ ব্যাংকের মধ্যে দাম কমেছে ২৩ এবং অপরিবর্তিত আছে নয় ব্যাংকের শেয়ারের দাম। সাপ্তাহিক লেনদেনে শেষে মাত্র চার ব্যাংকের শেয়ারের দাম ছিল ঊর্ধ্বমুখী।

ব্যাংকের বাইরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারেও বেহাল দশা। গত পাঁচ কার্যদিবসে এ খাতে শেয়ারের দাম কমেছে ২৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ এবং লেনদেন হওয়া শেয়ারের পরিমাণ কমেছে ৪০ দশমিক ৯৫ শতাংশ। তালিকাভুক্ত ২৩ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দাম কমেছে ১৯, বেড়েছে তিন এবং অপরিবর্তিত আছে একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম।

রীতিমতো ধস নেমেছে সাধারণ বীমা এবং জীবন বীমা খাতের শেয়ারে। পাঁচ কার্যদিবসে সাধারণ বীমা খাতে শেয়ারের দাম কমেছে ৪৩ দশমিক ২৩ শতাংশ এবং জীবন বীমা খাতে এ দরপতনের পরিমাণ ৫৯ দশমিক ১৬ শতাংশ।

ঢাকার পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে অরিয়ন ইনফিউশন লিমিটেডের। প্রতিদিন গড়ে কোম্পানিটির ২১ কোটি ৪৬ লাখ টাকার শেয়ার ক্রইয়-বিক্রয় হয়েছে। লেনদেনে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে প্রাইম ব্যাংক এবং শীর্ষ তৃতীয়তে আছে বিচ হ্যাচারি লিমিটেড।

পাঁচ কার্যদিবসে ব্লক মার্কেটে ১১৪ কোটি ৭০ লাখ টাকার শেয়ার বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে প্রাইম ব্যাংক সর্বোচ্চ ৪০ কোটি এবং বিচ হ্যাচারি ১৮ কোটি ৮০ লাখ টাকার শেয়ার বিক্রি করেছে।

দরবৃদ্ধিতে ডিএসইতে শীর্ষে আছে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স। এক সপ্তাহে জেড ক্যাটাগরির এ কোম্পানিটির দাম বেড়েছে ১৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অন্যদিকে দরপতনে শীর্ষে উঠে এসেছে এস আলম কোল্ড রোলড স্টিলস লিমিটেডের নাম। পাঁচ কার্যদিবসে কোম্পানিটির দাম কমেছে ১৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

করুণ দশা চট্টগ্রামেও

ঢাকার মতো চট্টগ্রামের বাজারেও অব্যাহত ছিল পতনের ধারা। ১৪ হাজার ৬৩৩ সার্বিক সূচক নিয়ে শুরু হওয়া লেনদেন শেষ কার্যদিবসে এসে ঠেকেছে ১৪ হাজার ৫০২ পয়েন্টে।

লেনদেনে অংশ নেয়া ৩২৯ কোম্পানির মধ্যে পুরো সপ্তাহজুড়ে দাম কমেছে ২১৫ এবং অপরিবর্তিত ছিল ২৯ কোম্পানির। বিপরীতে দাম বেড়েছে মাত্র ৮৫ কোম্পানির শেয়ারের।

দরপতনের তালিকায় শীর্ষে উঠে এসেছে তসরিফা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। বি ক্যাটাগরির এ কোম্পানিটি পাঁচ কার্যদিবসে সাড়ে ১৭ শতাংশ দাম হারিয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রামের বাজারে ভালো অবস্থানে থাকা এস আলম কোল্ড রোলড স্টিলস লিমিটেড গত সপ্তাহে দর হারিয়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ।

চট্টগ্রামে সপ্তাহজুড়ে দরবৃদ্ধির শীর্ষে আছে ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিটিক্যালস লিমিটেড। বি ক্যাটাগরির এ কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়েছে ১৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ। অন্যদিকে জেড ক্যাটাগরির আরেক কোম্পানি ন্যাশনাল টি কোম্পানি লিমিটেডের দাম বেড়েছে ১৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ। পুরো সপ্তাহে চট্টগ্রামের পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে টেলিকম কোম্পানি রবির শেয়ার।

কমিশনে অস্থিরতা

পুঁজিবাজারে পতনের পাশাপাশি নজিরবিহীন অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে এ বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি)। ২০২৪ সালের আগস্টে কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান রাশেদ মাকসুদ যোগদানের পর লাগাতার পতনে তোপের মুখে পড়েন সাধারণ বিনিয়োগকারীদের।

সাধারণ বিনিয়োগকারী থেকে ব্রোকারেজ হাউজের কর্তাব্যক্তিরা বিভিন্ন সময়ে সংবাদমাধ্যমে বলেন, কমিশন বাজারে স্নায়বিক চাপ উপেক্ষা করে একের পর এক যে সব সংস্কার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তাতে করে বাজার আরো খারাপের দিকে যাবে।

সে সময়ে বাজার ধসের কারণে রাশেদ মাকসুদকে দায়ী করে তার পদত্যাগের দাবি তোলেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। তারা মতিঝিলে লাগাতার মিছিল এবং কমিশনের প্রধান ফটকে তালা পর্যন্ত ঝুলিয়েছিলেন।

বিনিয়োগকারীদের সামাল দিতে না দিতে চলতি বছর খোদ নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের তোপের মুখে পড়েছে রাশেদ মাকসুদ কমিশন। বুধবার (৫ মার্চ) কমিশন চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে চেয়ারম্যান এবং কমিশনারদের অবরুদ্ধ করে রাখে বিএসইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর সহায়তায় রাশেদ মাকসুদ এবং অন্যান্য কমিশনাররা বের হয়ে আসতে পারলেও পদত্যাগ করবে না বলে জানায় এ কমিশন চেয়ারম্যান।

এদিকে আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, রাশেদ মাকসুদ পদত্যাগ না করলে লাগাতার কর্মবিরতিতে যাবেন তারা। সে হিসাবে রোববার (৯ মার্চ) থেকে বিএসইসিতে স্থবিরাবস্থা সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক পরিচালক বলেন, গত ১৫ বছর ধরে বিএসইসি এক ধরনের খামখেয়ালি করে আসছে। এতে করে কমিশনের এসব একরোখা আচরণ এবং সিদ্ধান্তে সবাই অতিষ্ঠ। বর্তমানে কমিশনের মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে অসন্তোষ, যা বাজারে মোটেই ভালো কোনো বার্তা দেয় না।

শিগগিরই কমিশনের এসব সমস্যা সমাধান না হলে এবং বাজার সংস্কারে গঠিত টাস্কফোর্সের দেয়া সুপারিশ ধাপে ধাপে কার্যকর করে আগাতে না পারলে দেশের পুঁজিবাজার দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির মুখে পড়বে- এমনটাই আশঙ্কা বাজার বিশ্লেষকদের।

সূত্র : ইউএনবি