আমদানির ফলের ওপর পতিত সরকারের বিলাস পণ্যের তকমা এখনো বহাল
উচ্চমূল্যের কারণে ফল খেতে পারছে না সাধারণ মানুষ
বিলাসী পণ্য হিসেবে গাড়িতে উচ্চ শুল্ক বিদ্যমান। মদ ও সিগারেটের ক্ষেত্রে ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে উচ্চ শুল্ক আরোপ করা হয়। কিন্তু এর পরই সর্বোচ্চ শুল্ক-কর দিতে হয় তাজা ফল আমদানিতে।

নূরুল মোস্তফা কাজী চট্টগ্রাম ব্যুরো
বাংলাদেশ ফল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। রোগীর পথ্য হিসেবে দেশী-বিদেশী ফল নিত্য অনুসঙ্গ হলেও আমদানির ফল এ দেশে বিলাস পণ্য হিসেবে(!) চিহ্নিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তালিকায়। পতিত সরকারের আমলে বিলাসী দ্রব্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হলেও তা এখনো বহাল রয়েছে। এতে অত্যাবশ্যক পণ্য ফল এখন সাধারণ্যের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এমনিতেই সারা বছর রোগীর পথ্য এবং পুষ্টির উৎস হিসেবে ফলের চাহিদা থাকে। রমজানে বিদেশী ফলের মধ্যে সর্বোচ্চ চাহিদা থাকে কমলা ও মাল্টার। এর পরে থাকে আপেল ও নাশপাতির। কিন্তু রমজান মাস ঘনিয়ে আসার আগ মুহূর্তেই সরকার ফল আমদানিতে বিগত সরকারের আরোপিত বাড়তি শুল্কের পাশাপাশি ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে ৩০% করে দেয়। এতে ফলের বাজারে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশে ফলের দামে রয়েছে বিস্তর ফারাক।
বাংলাদেশে ডলার সঙ্কটের অজুহাতে ২০২২ সালের মে মাসে তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকার সব ধরনের বিদেশী ফল আমদানিতে ২০% নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বা রেগুলেটরি ডিউটি আরোপ করিয়েছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) দিয়ে। খাদ্য-পণ্য হওয়া সত্ত্বেও বিদেশী ফলকে ২০১২ সালে আওয়ামী লীগ সরকার এনবিআরকে দিয়ে বিলাস-পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। আগে যেখানে বিদেশী ফলের ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কহার ছিল ৩%, তখন সেটি বাড়িয়ে করা হয় ২০ শতাংশ। অভিযোগ রয়েছে, পতিত সরকারের ঘনিষ্ঠরা জনগণের টাকা লুটে নিয়ে বিলাসদ্রব্য হিসেবে উচ্চ দামে বিদেশী ফল খেত আর জনগণকে এসব ফল খাওয়া থেকে বিরত রাখতেই উচ্চ শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল।
বর্তমানে ফল আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক (সিডি), ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি), ৩০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক (এসডি), ১০ শতাংশ অগ্রিম কর (এটি), ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম কর আছে। বিলাসী পণ্য হিসেবে গাড়িতে উচ্চ শুল্ক বিদ্যমান। মদ ও সিগারেটের ক্ষেত্রে ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে উচ্চ শুল্ক আরোপ করা হয়। কিন্তু এর পরই সর্বোচ্চ শুল্ক-কর দিতে হয় তাজা ফল আমদানিতে।
আমদানি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০২২ সালে সরকার ডলার সঙ্কটের অজুহাতে বিদেশী ফল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে যে ২০% নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করে ওই নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কতো বহাল আছেই বরং তা গত মাসে ১০ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০% করা হয়েছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে ফল আমদানিতে ১৩৬ শতাংশ শুল্ক-কর দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ এক কেজি মাল্টা যদি বিদেশ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে কোনো আমদানিকারক কিনে আনেন সেই ১০০ টাকার উপর আরো ১৩৬ টাকা সরকারকে দিয়ে সেটির মূল্য ২৩৬ টাকা দরের ফল হিসেবেই বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এর উপর কয়েক দিন আগে নতুন করে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা এর মতো বাড়তি শুল্কায়ন ভ্যালুর ভিত্তিতে শুল্ক-কর আদায় করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টদের দাবি। ফলে অস্থির হয়ে উঠেছে ফলের বাজার।
পাইকারি বিক্রেতা মো: আলাউদ্দিন এ বিষয়ে নয়া দিগন্তকে বলেন, চাহিদা থাকলেও দাম বেশি হওয়ায় অধিকাংশ মানুষ পর্যাপ্ত ফল কিনতে পারে না। ফলে বাজারে অবিক্রীত ফলের পরিমাণ যেমনি বাড়ছে, তেমনি অনেক ফল নষ্টও হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ফল ব্যবসায়ীরা ব্যবসায় টিকে থাকাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চাইলেই ফলের দাম মানুষের নাগালের মধ্যে চলে আসবে। তিনি বলেন, ফল ক্রয়ে সর্বোচ্চ চাহিদা কমেছে স্বল্প আয়ের মানুষদের। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, অল্প আয়ের মানুষেরা সাধারণত ভ্যান থেকে ফল কিনেন। আগে যেখানে একজন ভ্যানওয়ালা ৬-৮ ক্যারেট ফল বিক্রি করতো তারা এখন ২ ক্যারেটও বিক্রি করতে পারছে না।
এ দিকে ভোক্তাদের অভিযোগ, পতিত সরকার বিদেশী ফলকে বিলাসদ্রব্য বানিয়ে উচ্চ শুল্ক আহরণের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিল। কিন্তু জুলাই বিপ্লবের ফলে গঠিত সরকারের আমলেও ওই বিলাসদ্রব্যের তালিকা থেকে ফলের নাম সরেনি। এতে মানুষ প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগান দিতে পারছে না।
লোকমান নামের এক ক্রেতার সাথে খুচরা ফলের দোকানে কথা হয় গতকাল বৃহস্পতিবার। তিনি বলেন, আপেল আগে সর্বোচ্চ দেড়শ’ টাকা কেজি কিনতাম এখন সেটা তিনশ’ টাকার নিচে দেয় না। আবার কেউ কেউ সাড়ে তিনশ’ টাকাও চায়। মাল্টা ছিল একশ’-দেড়শ’ টাকার মতো, সেটা এখন ২৭০ টাকার মতো। কমলা আগে ডজন হিসেবে কিনতাম, এখন সেটা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে প্রায় তিনশ’ টাকায়। এত দাম দিয়ে মানুষ কিভাবে ফল খাবে। তাই আগে যা কিনতাম ওই টাকায় এখন অর্ধেক পাই।
পুষ্টিবিদদের মতে, প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির প্রতিদিন ৮০ গ্রাম ফল খাওয়া দরকার। কিন্তু বাংলাদেশের জনসংখ্যার অনুপাতে নাগরিকদের পুষ্টি চাহিদার অর্ধেকও স্থানীয়ভাবে পূরণ করা সম্ভব নয় বলে সংশ্লিষ্টদের দাবি। তবুও নিত্য চাহিদার ফলকে বিলাসপণ্য হিসেবে রীতিমতো উচ্চ শুল্ক-কর আহরণের একটি অজুহাত হিসেবে দেখছেন ভোক্তারা।
বাংলাদেশে মূলত ফ্রেশ ফ্রুটস ও ড্রাই ফ্রুটস এই দুই ক্যাটাগরিতে বিদেশ থেকে ফল আমদানি করা হয়ে থাকে। একাধিক আমদানিকারক জানিয়েছেন, বাংলাদেশ মূলত মিসর, ভারত, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এই দুই ক্যাটাগরির ৩৮ ধরনের ফল আমদানি করে। প্রতি বছর বিদেশ থেকে গড়ে সাত লাখ টনের অধিক ফল আমদানি হলেও গত ২০২২-২০২৩ অর্থবছর ও ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ফল আমদানি কমেছে। এনবিআরের হিসাবে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার বিদেশী ফল আমদানি হয়েছে। এসব ফল আমদানি থেকে সরকার ৫ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করেছে।
বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী দেশ সমূহের ফলের বাজার
গত বুধবার চট্টগ্রামের ফলমন্ডির পাইকারি বাজারে প্রতিকেজি সবুজ আঙ্গুর বিক্রি হয়েছে ২৬৫ টাকা দরে (২০ কেজির ক্যারেট ৫৩০০ টাকায়), যা খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩৩০-৩৫০ টাকা পর্যন্ত। আর প্রতিকেজি কালো আঙ্গুর পাইকারিতে ৩৫০ টাকায় (১০ কেজির ক্যারেট ৩৫০০ টাকা) যা খুচরা বাজারে ৪৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতিকেজি কমলা পাইকারি বাজারে ২০৮ টাকা (২৫ কেজির ক্যারেট ৫২০০ টাকা) দরে যা খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৫০-২৮০ টাকা দরে। প্রতিকেজি মাল্টা পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৪৭ টাকা দরে (১৫ কেজির ক্যারেট ৩৭০০ টাকা), যা খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ২৭০-২৯০ টাকা দরে। প্রতিকেজি আনার পাইকারিতে ৩৭০ টাকা দরে, যা খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ৪০০-৪২০ টাকা দরে। নাশপাতি প্্াইকারি বাজারে প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকা দরে (১০ কেজি ক্যারেট ২৫০০ টাকা), যা খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকা দরে।
গতকাল প্রতিবেশী দেশ ভারতের বাজারে (এক মার্কিন ডলার=৮৭.০৯ রুপি) প্রতিকেজি মাল্টা সর্বোচ্চ ৯০ রুপি, সবুজ আঙ্গুর-৭৫-১০০ রুপি, কালো আঙ্গুর-১০০-১৪০ রুপি, আপেল-১০৫-১৭০ রুপি দরে বিক্রি হয়েছে।
পাকিস্তানের মুদ্রামান বাংলাদেশী টাকার বিপরীতে অনেক নিম্নে থাকলেও(এক মার্কিন ডলার= ২৭৬.৩৯ পাকিস্তানি রুপি) পাকিস্তানে গতকাল প্রতিকেজি মালটা ২০০ পাকিস্তান রুপি, কেনু- ২৪০ পাকিস্তান রুপি, আনার ৬৯৫ পাকিস্তান রুপি, সবুজ আঙ্গুর ৩০০-৩১০ পাকিস্তানি রুপি, আপেল-১৮০- ২৫০ পাকিস্তান রুপি দরে বিক্রি হয়েছে।
ফল আমদানিকারকরা জানান, ফ্রেশ এবং ড্রাই ফ্রুটে অত্যধিক শুল্ক আরোপের কারণে সাধারণ মানুষের নাগালে আসছে না ফলের মূল্য। এককেজি আপেল ১০ ডলারে কিনে আনার পর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ক্রয়মূল্য বাড়তি ১৪ ডলার ধরে ১৩৬শতাংশ শুল্ক-কর আদায় করছে। ফলে শুল্ক অনেক বেড়ে যাচ্ছে। অথচ ১৯৫৬ সালের এসেনশিয়াল কমোডিটিজ অ্যাক্ট অনুযায়ী, খাদ্যপণ্য হিসেবে তাজা ফল অত্যাবশকীয় পণ্য।
আমদানিকারকদের মতে এবং বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী এখন ১০০ টাকার ফল আমদানি করলে ১৩৬ টাকা শুল্ক-কর দিতে হয়। অর্থাৎ বিদেশ থেকে ১০০ টাকায় আপেল, আঙ্গুর, নাশপাতি, কমলা, মাল্টাসহ বিভিন্ন ধরনের ফল কিনে আনার পর তাতে শুল্ক কর যোগ হয়েই ১০০ টাকার ফলের দাম হয়ে যায় ২৩৬ টাকা। ভোক্তাদের হাতে আসতে ্এর সাথে যুক্ত হয় পরিবহন ব্যয়সহ বিক্রেতাদের নানা খরচ।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোটার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নুরুদ্দিন আহমেদের দাবি ফল আমদানিতে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক প্রযোজ্য হতে পারে না। তিনি জানান, সাধারণত জরুরি অবস্থা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিশেষ তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পণ্য আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বসানো হয়। ন্যাশনাল ট্যারিফ পলিসি ২০২৩ অনুযায়ীও ফল আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বসানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে মনে করে ট্যারিফ কমিশন। নুরুদ্দিন আহমেদ বলেন, আপেল, কমলা, নাশপাতি, মাল্টা বিলাসী পণ্য হতে পারে না। রোগীর পথ্য হিসেবে যেমন ব্যবহার হয়, তেমনি পুষ্টিমান নিশ্চিত করতেও ফল খাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। বিদ্যমান উচ্চ শুল্ক অত্যন্ত অমানবিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, অত্যধিক দামের কারণে সাধারণ মানুষ এখন ফল খেতে পারছেন না।