বাবা ফিরে আসবে এ আশায় দিন কাটে শহীদ মিলনের শিশু কন্যা হুমায়রার

৫ আগস্ট আমার স্বামী আন্দোলনে গেলে আওয়ামী লীগের কর্মীরা তাকে পিটিয়ে ও মাথায় পাথর মেরে আহত করে। বিভিন্ন হাসপাতালে নেয়ার পর শেষে কুমিল্লা ট্রমা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬ আগস্ট আইসিইউতে মারা যান।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
13.03.25
শহীদ মিলন | বাসস

‘আব্বু ঘুম থেকে ওঠে না কেন? আব্বু কবে আসবে? এত ঘুমায় কেন?’-এমন সব প্রশ্ন করেই প্রতিদিন পার করছে ছোট্ট শিশু হুমায়রা আক্তার (৬)। তার আশা, ঘুম থেকে উঠে তার আব্বু চলে আসবে, তার জন্য চকলেট আর চিপস নিয়ে আসবে।

হুমায়রা কুমিল্লায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ মিলন মিয়ার (৩২) একমাত্র সন্তান। সে স্থানীয় খান্নাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী।

কিভাবে শহীদ হলেন মিলন মিয়া

পরিবার সূত্রে জানা যায়, ২৪-এর ৫ আগস্ট কুমিল্লার নাঙ্গলকোট পৌর এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দেন মিলন। সেখানেই আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তাকে পিটিয়ে আহত করে। প্রথমে তাকে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দেয়া হয়। এরপর নাঙ্গলকোট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়। সেখান থেকে পাঠানো হয় কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। কিন্তু আর্থিক সঙ্কটের কারণে তাকে ঢাকায় না নিয়ে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানে দু’দিন আইসিইউতে থাকার পর ৭ আগস্ট তিনি মারা যান।

শহীদ মিলনের স্ত্রী খালেদা আক্তার বলেন, ‘৫ আগস্ট আমার স্বামী আন্দোলনে গেলে আওয়ামী লীগের কর্মীরা তাকে পিটিয়ে ও মাথায় পাথর মেরে আহত করে। বিভিন্ন হাসপাতালে নেয়ার পর শেষে কুমিল্লা ট্রমা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬ আগস্ট আইসিইউতে মারা যান। তবে হাসপাতালের বিল পরিশোধ করতে না পারায় ৭ আগস্ট তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।’

শহীদ মিলনের পরিবার

শহীদ মিলন মিয়া কুমিল্লার নাঙ্গলকোট পৌরসভার খান্নাপাড়া এলাকার কবিরাজ বাড়ির বাসিন্দা। তার বাবা মো: নুর ইসলাম (৬৫) পেশায় সিএনজিচালক। মা নুরুন্নেছা (৫৬) ও শহীদ মিলনের স্ত্রী খালেদা আক্তার (২৬) গৃহিণী।

দুই ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে মিলন ছিলেন পঞ্চম। বড় বোন মর্জিনা আক্তার (৩৮), দ্বিতীয় বোন আসমা আক্তার (৩৬) ও তৃতীয় বোন রাবেয়া আক্তার (৩৪) ও চতুর্থ বোন ফজিলাতুন্নেছা (১৮)। সবাই বিবাহিত। ছোট বোন আকলিমা আক্তার (১৫) স্থানীয় শ্রীকান্ত মাদরাসার দশম শ্রেণির ছাত্রী। ভাই মামুন মিয়াও (৩৩) বিবাহিত। তিনি পেশায় সিএনজিচালক।

শহীদ মিলনের বাবা নুর ইসলাম বলেন, ‘আমার দুই ছেলে ও পাঁচ মেয়ে। আমি ও আমার দুই ছেলে সিএনজি চালিয়ে সংসার চালাতাম। আমার ছেলে মিলনকে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা পিটিয়ে ও মাথায় পাথর মেরে হত্যা করেছে। ছেলের একমাত্র মেয়ে ও স্ত্রী আজ অসহায়।’

তিনি জানান, ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছি। এছাড়া মুরাদনগরে এক অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ দুই লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন।’

শহীদ মিলনের মা নুরুন্নেছা বলেন, ‘আমার ছেলেটাকে ওরা পিটিয়ে হত্যা করেছে। সে আহত অবস্থায় বাসায় আসে। আমি কাছে গেলে মা ডাকতে চেয়েও পারেনি। মুখ দিয়ে কথা বের হয়নি। মা বলে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু তার শেষ কথাটা আর শুনতে পারলাম না।’

‘আমার স্বামীর স্বপ্ন ছিল মেয়েকে মানুষ করা’

শহীদ মিলনের স্ত্রী বলেন, ‘আমার বাবা নেই, স্বামীও মারা গেছে। সন্তান হুমায়রাই এখন আমার একমাত্র অবলম্বন। শ্বশুরবাড়ি ও বাবার বাড়ির সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ। দিনে আনে, দিনে খায়। কেউই আমার ভরণপোষণ চালানোর অবস্থায় নেই।’

তিনি আরো বলেন ‘আমার স্বামীর স্বপ্ন ছিল মেয়েকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করার। আমি আমার মেয়েটাকে লেখাপড়া করাতে চাই, স্বামীর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চাই। তাই সরকার বা বিত্তবানদের সহযোগিতা চাই। যদি ছোট একটি চাকরি পেতাম, তাহলে কোনো রকম জীবন চালাতে পারতাম। নয়তো পথে বসতে হবে।’ সূত্র : বাসস