দুই সন্তান নিয়ে অনিশ্চয়তায় শহীদ মঞ্জুর স্ত্রী রহিমা

গত বছর ২০ জুলাই ঢাকার বড়বাড়ী এলাকায় জয়বাংলা রোডে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মঞ্জু মিয়া (৪০)। তার মৃত্যুর পর স্ত্রী রহিমা বেগম (৩০) এবং তাদের দুই সন্তান এখন এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
11.03.25

শহীদ রাজমিস্ত্রি মঞ্জু মিয়াকে স্মরণ করে প্রায়ই তার দুই অবুঝ সন্তানকে বুকে জড়িয়ে কাঁদেন রহিমা বেগম। স্বামীকে হারিয়ে সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তার।

গত বছর ২০ জুলাই ঢাকার বড়বাড়ী এলাকায় জয়বাংলা রোডে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মঞ্জু মিয়া (৪০)। তার মৃত্যুর পর স্ত্রী রহিমা বেগম (৩০) এবং তাদের দুই সন্তান এখন এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি।

হতদরিদ্র মঞ্জু-রহিমা দম্পতি তাদের সন্তানদের নিয়ে যে ছোট ছোট স্বপ্ন দেখেছিলেন তা হঠাৎ করেই সম্পূর্ণরূপে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। পাঁচ বছরের মেয়ে মোহনা আক্তার মরিয়ম দীর্ঘদিন ধরে টনসিলের সমস্যায় ভুগছে, আর আড়াই বছরের ছেলে আবু বকর হাঁপানিতে আক্রান্ত। চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে না পেরে রহিমা ভয়াবহ সঙ্কটে দিন কাটাচ্ছেন।

২০১৭ সালে রংপুরের পীরগাছা উপজেলার জুয়ানেরচর গ্রামের দিনমজুর এনছার আলীর ছেলে মঞ্জুর সাথে রহিমার বিয়ে হয়। এর আগে মঞ্জু জয়পুরহাটের আক্কেলপুরের এক নারীকে বিয়ে করেছিলেন, যাদের দুই ছেলে রয়েছে। বড় ছেলে আলম (১৭) নবম শ্রেণিতে এবং ছোট ছেলে রাসেল (১২) পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে।

মঞ্জু তার মা-বাবার তিন ছেলে এবং এক মেয়ের মধ্যে বড় সন্তান। তার দরিদ্র খেতমজুর ভাই শহিদুল ইসলাম (৩০) ও সোহেল রানা (১৮) বিবাহিত। তারা আলাদা থাকেন। একমাত্র বোন রিনা খাতুন (২৪)-এর বিয়ে হয়েছে একই এলাকার ধলু মিয়া (৩২)-এর সাথে।

মঞ্জুর মা শাহিতন খাতুন (৫৮) গৃহিণী। তাদের পরিবারের ২০ শতাংশ জমি ছাড়া আর কোনো চাষযোগ্য জমি নেই। সেখানে একটি ছোট বাড়ি রয়েছে। মঞ্জুর মা-বাবা ও ভাইয়েরা দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটান। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন মঞ্জু।

মঞ্জুর স্ত্রী রহিমা তার মা-বাবার চার ছেলে এবং চার মেয়ের মধ্যে ষষ্ঠ। রহিমার ভূমিহীন ও অসুস্থ বাবা আবদুর রহমান (৮৫) রংপুরের পীরগাছা উপজেলার তাম্বুলপুর গ্রামে তিস্তা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ওপর নির্মিত একটি ঘরে তার মা লাইলী বেগম (৬০)-এর সাথে বাস করেন। তিনি বিছানায় শুয়ে তার শেষ দিনগুলি কাটাচ্ছেন। গত কয়েক দশক ধরে তিস্তা নদীর বার বার ভাঙনে আবদুর রহমান তার জমি, বাড়ি এবং সমস্ত সম্পত্তি হারিয়েছেন।

রহিমার ছোট ভাই রুবেল (১৫) রাজমিস্ত্রিদের একটি দলের সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করে এবং ছোট বোন জাহেদা বেগম (১৯) তার স্বামীর সাথে বিচ্ছেদের পর তার মা-বাবার কাছে ফিরে আসেন। অন্যান্য ভাই-বোনেরা বিবাহিত এবং আলাদাভাবে নিজ নিজ পরিবার নিয়ে বাস করেন।

রহিমা বলেন, ‘আমার স্বামী শহীদ হওয়ার পর আমি আমার শ্বশুরবাড়িতে অসহনীয় সমস্যার কারণে সম্মান ও মর্যাদার সাথে থাকতে পারিনি। অনন্যোপায় হয়ে আমাকে দুই সন্তানকে নিয়ে আমার হতদরিদ্র মা-বাবার কাছে ফিরে আসতে হয়েছে।’

রহিমা এখন তার বাবার বাড়ির একটি মাত্র ঘরে সাতজন লোকের সাথে এক দুর্বিষহ পরিবেশে থাকেন। যাদের মধ্যে তার মা-বাবা, এক ভাই, একজন তালাকপ্রাপ্ত এক বোন, তার দুই সন্তান রয়েছেন। একই ঘরের অন্য কোণে রহিমার একটি গরুও থাকে।

সাত সদস্যের পুরো পরিবার রহিমার ছোট ভাই রুবেলের অতি সামান্য আয়ের ওপর নির্ভর করে চলে। সে আবার প্রতিদিন কাজও পায় না। কখনো কখনো তাদের অনাহারে থাকতে হয়।

রহিমা বলেন, ‘আমার স্বামী আমার জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ ছিল। আমার আর সেই সম্পদ আর নেই। পুলিশ আমার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করে আমার বেঁচে থাকার স্বপ্নও কেড়ে নিয়েছে।’

স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে গ্রামে দারিদ্র্যের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ভূমিহীন মঞ্জু তাদের কঠিন সংসারের খরচ বহন করার জন্য আড়াই বছর আগে তার স্ত্রী রহিমাকে নিয়ে ঢাকায় যান। একমাত্র মেয়ে ও একমাত্র ছেলেকে রহিমার মা-বাবার বাড়িতে রেখে ঢাকায় যেতে হয়।

ঢাকা শহরে মঞ্জু রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। তার স্ত্রী একটি পোশাককারখানায় কাজ করতেন। তারা কঠোর পরিশ্রম করতেন এবং ঢাকা শহরের জয়বাংলা রোডের বড়বাড়ী এলাকায় একটি ভাড়া বাড়িতে থাকতেন।

অশ্রুসিক্ত নয়নে রহিমা বলেন, ‘আমি আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য অনেক আশা নিয়ে স্বামীর হাত ধরে ঢাকায় গিয়েছিলাম। এখন আমার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আমাদের নিষ্পাপ শিশুদের দেখাশোনা কে করবে এবং কার কাছে বিচার চাইব? আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে বিচার চাই।’

বিগত কয়েকদিনের মতো মঞ্জু ২০ জুলাই দুপুর ১টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মিছিলে অংশগ্রহণের জন্য তার বাড়ি থেকে বের হন। কিছুক্ষণ পরেই দুপুর দেড়টার দিকে ঢাকার বড়বাড়ী জয়বাংলা রোড এলাকায় পুলিশের ছোঁড়া একটি প্রাণঘাতী গুলি তার পেটের নিচে সামনের বাম দিক দিয়ে ঢুকে পেছনের ডান দিক দিয়ে বেরিয়ে গেলে মঞ্জু গুরুতর আহত হন। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে তিনি দ্রুত মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।

রহিমা বলেন, ‘তখন মঞ্জু কোনোভাবে আমার মোবাইল ফোন নম্বরটি মিছিলে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের কাছে বলতে পারে। কেউ যখন আমাকে মোবাইলে জানায় যে মঞ্জু পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হয়েছেন।’

রহিমা দ্রুত সেখানে ছুটে গিয়ে স্থানীয়দের সহায়তায় মঞ্জুকে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (এসটিএএমসিএইচ) নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (ডিএমসিএইচ) নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।

রহিমা বলেন, ‘একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে আমি মঞ্জুকে নিয়ে দুপুর একটা ৪৫ মিনিটে এসটিএএমসিএইচ থেকে ডিএমসিএউচ-এর উদ্দেশ্যে রওনা হই। কিন্তু পুলিশ অনেকবার আমাদের পথ আটকে দেয়। কোনোমতে আমরা বিকেল সাড়ে ৪টার মধ্যে উত্তরা এলাকায় যেতে পারি। মঞ্জু তখন পথেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।’

আবেগাপ্লুত রহিমা বলেন, ‘পুলিশ যদি ডিএমসিএইচ-এ যাওয়ার পথে বাধা না দিত এবং আমরা সময়মতো সেখানে পৌঁছতে পারতাম, তাহলে হয়ত মঞ্জু বেঁচে যেত।’

তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী মঞ্জু খুব ভাল মানুষ ছিল। মৃত্যুর আগে সে আমাকে বার বার বলেছিল, মরিয়মের মা, আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি মনে হয় আর বাঁচব না। আল্লাহ মহান। তুমি আমার পাগলী মেয়ে মরিয়মকে দেখে রাখিও।’

রহিমা ৩৭ হাজার টাকায় একটি লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে স্বামীর লাশ তার জন্মস্থান জুয়ানেরচর গ্রামে নিয়ে যান এবং লাশ দাফনের জন্য পাঁচ হাজার টাকা এবং অন্যান্য কাজে ১৮ হাজার টাকা খরচ ছিল।

রহিমা বলেন, ‘আমরা ২১ জুলাই ভোর আড়াইটায় রংপুরের পীরগাছা উপজেলার জুয়ানেরচর গ্রামে পৌঁছাই এবং সকাল ১০টায় মঞ্জর লাশ দাফন করা হয়।’

তিনি আরো বলেন, এই খরচ মেটাতে তাকে অন্যদের কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা ধার করতে হয়।

মঞ্জুর বাবা এনছার আলী এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘কোনো বাবা তার সন্তানের লাশ দেখে খুশি হতে পারেন না। আমার ছেলে খুনি হাসিনার পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছে। আমি ন্যায়বিচার চাই এবং মঞ্জুর সন্তানদের জন্য সাহায্য চাই।’

রহিমার হতদরিদ্র বাবা আবদুর রহমান বলেন, ‘আমার অসহায় মেয়ে রহিমা তার দুই নাবালক সন্তানকে নিয়ে চিন্তিত। আমি কখনো ভাবিনি যে আমার মেয়ে এত অল্প বয়সে তার স্বামীকে হারাবে।’ যদিও মঞ্জু এবং রহিমার জমি-জমা ও বাড়ি ছিল না, তবুও তাদের পরিবারে কোনো অশান্তি ছিল না। সুখের কোনো অভাব ছিল না।’

রহিমা বলেন, ‘এখন আমার স্বামী নেই, থাকার জায়গা নেই, ঘর-বাড়ি নেই। আমি বুঝতে পারছি না কোথায় যাব বা কী করব। আমি বর্তমানে আমার বাবার বাড়িতে আছি। আমরা গরিব। গরিবদের কথা কেউ ভাবে না। আমি দুই সন্তান নিয়ে ভয়াবহ কষ্টে দিন কাটাই।’

এখন পর্যন্ত রহিমা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী থেকে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা পেয়েছেন। এই টাকা দিয়ে তিনি ৬০ হাজার টাকার ঋণ পরিশোধ করেছেন এবং লালন-পালনের জন্য একটি গরু কিনেছেন। জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন রহিমাকে চার লাখ এবং তার শ্বশুরকে এক লাখ টাকা দিয়েছে।

রহিমা বলেন, ‘চার লাখ টাকার মধ্যে আমি আমার স্বামীর প্রথম স্ত্রীর দুই ছেলে আলম এবং রাসেলকে দেড় লাখ টাকা ব্যাংকে হিসাব খুলে দিয়েছি। বাকি আড়াই লাখ টাকা দিয়ে আমি ৬০ শতাংশ চাষযোগ্য জমি লিজ নিয়ে সেখানে নিজেই ফসল চাষ করছি।’

এছাড়াও রহিমা পীরগাছা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমন্বয়কারী মো: শামসুর রহমান সুমনের কাছ থেকে চার হাজার টাকা পেয়েছেন।

রহিমা বলেন, ‘আমার সন্তানদের জরুরিভাবে উন্নত চিকিৎসা সেবা প্রয়োজন।’ আমি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে অবিলম্বে আমার সন্তানদের থাকার জন্য একটি বাড়ি এবং বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের আহ্বান জানাই। সূত্র : বাসস