‘মারা গেলে হাসিনার পতন না হওয়া পর্যন্ত আমার লাশ আনবে না’ : শহীদ ফাহমিন জাফর

জাফরের গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হওয়ার খবর পেয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পথে ওই দিন হাসিনার পেটোয়া বাহিনীর সদস্যরা আমাকে পদে-পদে বাধা দেয় এবং অশালীন আচরণ করে।

নয়া দিগন্ত অনলাইন
13.03.25
শহীদ ফাহমিন জাফর | বাসস

‘স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে গিয়ে আমার মৃত্যু হলে খুনি হাসিনার পতন না হওয়া পর্যন্ত তোমরা আমার লাশ ঘরে আনবে না।’

কথাগুলো ঐতিহাসিক জুলাই বিপ্লবের শহীদ টঙ্গী সরকারি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ফাহমিন জাফরের। কাঁদতে কাঁদতে এই প্রতিনিধিকে এ কথা জানান তার মা শিল্পী বানু।

ফাহমিন জাফর ২৪-এর ১৮ জুলাই বন্ধুদের সাথে ঢাকার উত্তরা এলাকায় ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হয়ে উত্তরার একটি মার্কেটের সিড়িতে লুটিয়ে পড়েন।

সহযোদ্ধা বন্ধুরা তাকে উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় ফাহমিন। ছররা গুলিতে সারাশরীর ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল তার।

ফাহমিন জাফর নওগাঁর আত্রাই উপজেলার তারাটিয়া গ্রামের বাসিন্দা। মা-বাবার চার সন্তানের মধ্যে ফাহমিন ছিলেন সবার ছোট। বুয়েটে পড়াশোনা করার ইচ্ছা বুকে নিয়ে মা শিল্পী বানুর সাথে ঢাকায় মামার বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করত ফাহমিন।

শহীদ জননী শিল্পী বানু বলেন, ‘জাফরের জন্ম হয়েছিল ১০ জুলাই ২০০৬ সালে। সেই জুলাই মাসেই আমার বুকের মানিককে আমার কোল খালি করে রক্তপিপাসা নিবৃত্ত করেছে খুনি হাসিনা।’

একপর্যায়ে জাফরের মা আবেগ-আপ্লুত হয়ে বলতে থাকেন, ‘জাফরের গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হওয়ার খবর পেয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পথে ওই দিন হাসিনার পেটোয়া বাহিনীর সদস্যরা আমাকে পদে-পদে বাধা দেয় এবং অশালীন আচরণ করে।’

তিনি আরো বলেন, ‘তারপরেও আমি পুলিশের সাথে বাগ্বিতণ্ডা করে হাসপাতালে পৌঁছে দেখি আমার বাবুটা (জাফর) আর নেই। ওই দিন ওই হাসপাতালের কর্তব্যরত একজন চিকিৎসক তাকে দ্রুত লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য তাড়া দিয়ে বলেন, ‘দেরি করলে পুলিশ আপনার ছেলের লাশ গায়েব করে দিতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া আমার বাবুর দেহখানার কথা মনে পড়লে আমি ঠিক মতো ঘুমাতে পারি না। আমি আমার বাবুসহ অন্যসব মায়ের কোল খালি করা সন্তান হত্যার বিচার চাই এবং খুনি হাসিনার ফাঁসি চাই।’

শহীদ ফাহমিন জাফরের বাবা শেখ আবু জাফর বলেন, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে পরিবারের হাল ধরতে চেয়েছিল ফাহমিন। ১৮ জুলাই ছেলের সাথে সকাল ১০টায় মোবাইল ফেনে শেষ কথা হয় তার।

ফাহমিনের বাবা বলেন, জানতে চাই কোথায় আছে সে, উত্তর দেয় আন্দোলনে আছি। বাবা তাকে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে যেতে বলেন। ‘ফিরল ঠিকই তবে লাশ হয়ে। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি।

জাফরের ফোনের শেষ কললিস্টে ছিল তার বাবার নাম্বার। কেউ একজন ওই নম্বরে ফোন করে জানায়, ফাহমিন এক্সিডেন্ট করেছে। জরুরিভাবে আপনারা হাসপাতালে আসেন।

জাফরের বাবা ওই সময় রাজশাহীর বাসায় অবস্থান করছিলেন। তিনি ঢাকায় জাফরের মা শিল্পী বানু এবং জাফরের মামা মোক্তাদিরকে ফোন করে তাড়াতাড়ি উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালে যেতে বলেন।

হাসপাতালে গিয়ে জাফরের লাশ বেডে পড়ে থাকতে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা। মা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। ওই রাতেই তারা জাফরের লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ি নওগাঁর আত্রাইয়ের উদ্দেশে রওনা দেন।

পরদিন ১৯ জুলাই শুক্রবার বাদ জুমা পারিবারিক কবরস্থানে ফাহমিন জাফরের লাশ দাফন করা হয়। গ্রামবাসী শহীদ জাফরের জন্য দোয়া করার পাশাপাশি তার খুনিদের বিচার দাবি করেন।

আত্রাইয়ের তারাটিয়া গ্রামে বসবাসরত ফাহমিন জাফরের চাচি সাথি বেগম এবং চাচা শেখ মসির উদ্দীন বাসসকে বলেন, জাফরের বাবা চাকরি সূত্রে পরিবার নিয়ে রাজশাহীতে বসবাস করেন।

তারা আরো বলেন, জাফরকে গ্রামের ছোট বড় সবাই ভালবাসত। সে ছিল শান্ত প্রকৃতির। মেধাবী জাফরের লেখাপড়া করে অনেক বড় হওয়ার ইচ্ছা ছিল। বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে সে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে আসত। সে সময় ও সবার আপন হয়ে যেত। সূত্র : বাসস