১৪ বছরেও জানা গেল না কারা কেন ধরে নিলো নুর আলমকে
তিন বোনের মধ্যে একমাত্র ভাই ছিল নুর আলম। কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবে চাকরি করতেন। আড়াই বছরের ছেলে স্ত্রী মা-বাবা বোনদের নিয়ে সুখের সংসার ছিল তাদের। পরিবারের এক নতুন অতিথি নুর আলমের আড়াই বছরের ছেলে ওমর ফারুকের যেন আহ্লাদের শেষ ছিল না।

আমিনুল ইসলাম
২০১১ সালের ২ জানুয়ারি দুপুর বেলা। আড়াই বছরের ছেলে ওমর ফারুককে নিয়ে ভাত খেতে বসেছিলেন নুর আলম। স্ত্রী রহিমা গরুর গোস্ত দিয়ে ভাত বেড়ে দিয়ে রান্নাঘরে কিছু কাজ সারছিলেন। এমন বন্ধু আল আমিন ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে বলে, ‘এখনো খাচ্ছিস, ওকে আনতে এয়ারপোর্ট যেতে হবে না, তাড়াতাড়ি কর। এরপর তড়িঘড়ি করে স্ত্রীকে ডাক দিয়ে বলেন ‘ছেলেকে খাওয়াও, আমি বের হবো, খাওয়া শেষ করেন। জামা প্যান্ট পরে পাশের ঘরে হাটতে থাকলে ছেলেটিও বাবার পিছু হাটতে থাকে। সে কোনোভাবেই বাবাকে ওই সময় বের হতে দিতে চাইছিল না। কিন্তু কাকে যেন রিসিভ করতে বন্ধু আল আমিনের সাথে এয়ারপোর্ট যাবেন তাই ছেলেকে পাত্তা দিচ্ছিলেন না। এরপর অপেক্ষায় থাকা আল আমিনের সাথে বেরিয়ে আর ফিরে আসেননি নুর আলম।
এভাবেই তথ্যগুলো জানান, নিখোঁজ নুর আলমের বোন আয়েশা। তিনি বলেন, ঢাকার কচুক্ষেতের পুরান বাজারের একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন তারা। তিন বোনের মধ্যে একমাত্র ভাই ছিল নুর আলম। কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবে চাকরি করতেন। আড়াই বছরের ছেলে স্ত্রী মা-বাবা বোনদের নিয়ে সুখের সংসার ছিল তাদের। পরিবারের এক নতুন অতিথি নুর আলমের আড়াই বছরের ছেলে ওমর ফারুকের যেন আহ্লাদের শেষ ছিল না। বাবা-মায়ের পাশাপাশি তিন ফুফু দাদা-দাদির ভালোবাসায় সিক্ত ছিল ওমর ফারুক। নুর আলমের স্বপ্ন ছিল ছেলে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন। আজ অভাবের কারণে সেই ছেলে পড়া-লেখা করতে না পেরে কনষ্ট্রাকশনের কাজ শিখছে।
তিনি বলেন, আল আমিনের সাথে যাওয়ার পর রাত ১১টার দিকে নুর আলমের মোবাইলে কল দিয়ে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরিবারের সবাই ভাবছিল হয়তো মোবাইলের ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু রাত ১২ বাজলেও যখন বাসায় ফিরছিল না তখন টেনশন শুরু হয়। সারা রাত বাসায় না ফেরায় পরদিন ভোরে তার বন্ধু আল আমিনের বাসায় যান নুর আলমের বাবাসহ পরিবারের সদস্যরা।
আল আমিনের বাবা তাদের বলেন ‘আল আমিনও রাতে বাসায় ফেরেনি’। এ কথা শুনে তারা ফিরে আসেন, কিছু দূর ফিরে আবার তাদের বাসায় দেখেন আল আমিন বাসাতেই ঘুমিয়ে রয়েছেন। তখন তার কাছে নুর আলমের কথা জানতে চাইলে ‘আল আমিন বলে ‘আমি বলতে পারব না, বললে আমাকেও মেরে ফেলবে। আমি কিছুই জানি না, তোমরা চলে যাও। বেশ কয়েকবার জানতে চাওয়া হলে আল আমিন বলেন, রাত ১১টায় বিমানবন্দর ওভারব্রিজ এলাকা থেকে একদল দুর্বৃত্ত আমাদের দুজনকে (নুর আলম ও আল আমিনকে) একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। গাড়িতে ওঠার পর চোখ বেঁধে ফেলে। এরপর গাজিপুরের দিকে নিয়ে আমাকে রাস্তার উপর ফেলে নুর আলমকে নিয়ে চলে যায়। ফেলার আগে এসব কথা কাউকে বললে আমাকে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দেয়। আমি আর কিছু বলতে পারব না’।
এ ব্যাপারে কাফরুল থানায় মামলা করতে গেলে একটি অভিযোগ গ্রহণ করে। কিন্তু মামলা বা জিডির কোনো নাম্বার দেয়নি। র্যাব. ডিবি, পুলিশ সদরদফতরসহ সব জায়গা দৌড়াদৌড়ি করেও নুর আলমের সন্ধান পাওয়া যায়নি। যখন আল আমিনকে আমরা শক্ত করে ধরার চেষ্টা করলাম তখনই এলাকার আওয়ামী লীগের নেতা সামসুর রহমান ওরফে সামসু সালিসের নামে তাকে সেইফ করে অন্য এলাকায় পাঠিয়ে দেয়। কারা কেন আমাদের ভাইকে গুম করল কিছুই জানতে পারলাম না।
এরপর থেকে সব কিছু তচনচ হয়ে যায় সেই সময়ের আড়াই বছরের ছেলে ওমর ফারুকের। বাবা ফিরে না আসায় মা অন্য জায়গায় বিয়ে করেন। চরম অভাবে অর অনটন নিয়ে একবার মায়ের কাছে একবার দাদার কাছে, আবার কখনো নানার কাছে ছুটতে থাকে। পড়াশোনা করতে না পেরে বাধ্য হয়ে কনষ্ট্রাকশনের কাজ শিখছে। প্রচণ্ড কষ্টে মাঝে মধ্যে ওমর ফারুক রুমের দরজা বন্ধ করে কাঁদে। আবার কখনো সবার সামনেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলে ‘আজ যদি বাবা থাকতো, আমার জীবনটা এমন ছন্নছাড়া হতো না, আমিও অন্যদের মতো পড়াশোনা করতাম। আমার মা আমার কাছেই থাকতেন। এক বাবা হারিয়ে যাওয়ায় পুরো জীবনটাই এলোমেলো হয়ে গেল।