ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানো সেই ওবায়দুর রহমান ঈশ্বরগঞ্জে যা করছেন

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গুলি চালানো ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থানার ওসি (তদন্ত) ওবায়দুর রহমান ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর কাকতালীয়ভাবেই পদোন্নতি পেয়ে ঈশ্বরগঞ্জ থানার ওসি হয়ে যান।

3333
ঈশ্বরগঞ্জ থানার বর্তমান ওসি মো: ওবায়দুর রহমান | নয়া দিগন্ত

ঈশ্বরগঞ্জ (ময়মনসিংহ) সংবাদদাতা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থানার ওসি (তদন্ত) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ঈশ্বরগঞ্জ থানার বর্তমান ওসি মো: ওবায়দুর রহমান।

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর কাকতালীয়ভাবেই ওসি (তদন্ত) থেকে পদোন্নতি পেয়ে তিনি হয়ে যান ওসি। গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর ঈশ্বরগঞ্জ থানায় ওসি হিসেবে যোগদান করেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফুলবাড়িয়া থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাশেদুজ্জামানের নির্দেশনায় এবং ওসি (তদন্ত) ওবায়দুর রহমানের নেতৃত্বে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। এতে অনেকেই গুরুত্বর আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন।

আহতদের একজন আরিশ আহমেদ (১৫)। ফুলবাড়িয়া উপজেলার কুশমাইল ইউনিয়নের কুশমাইল গ্রামের কৃষক আশরাফুল ইসলামের ছেলে আরিশ ডান চোখ গুলিবিদ্ধ হন। এখন সে আর ওই চোখে দেখতে পান না।

আরিশ জানান, তার চোখ, মাথা, মুখসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ১৩টি ছররা গুলি লাগে।

তিনি বলেন, ‘ফুলবাড়িয়া থানা পুলিশের ছররা গুলিতেই আমার এই অবস্থা হয়েছে। তার জন্য থানার তৎকালীন প্রতিটি পুলিশ সদস্যই দায়ী।’

তার বাবা আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘গুলিবিদ্ধ হয়ে আমার ছেলে একটা চোখে দেখতে পায় না। ফুলবাড়িয়া থানার তৎকালীন ওসি এবং ওসি (তদন্ত)সহ সকল পুলিশ সদস্য ঘটনার সাথে জড়িত ছিল।’

বিষয়টি নিশ্চিত করে ময়মনসিংহ মহানগর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের সিনিয়র যুগ্ম-সদস্য সচিব ওয়ালিদ আহমেদ অলি বলেন, ‘আন্দোলন চলাকালীন সময়ে ফুলবাড়িয়া থানার তৎকালীন ওসি (তদন্ত) ওবায়দুর রহমান মোটেও ছাত্র-জনতার জন্য হেল্পফুল ছিলেন না।’

তিনি আরো বলেনে, ‘আওয়ামী দোসরদের সাথে নিয়ে ওবায়দুর রহমানের নেতৃত্বে ফুলবাড়িয়া থানা-পুলিশ গুলি চালিয়েছে। ৫ আগস্টের পর তিনি কীভাবে পদোন্নতি পেয়ে ওসি হয়েছেন বিষয়টি আমার বোধগম্য নয়। এ নিয়ে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলবো।’

তবে ওসি ওবায়দুর রহমান জানান, এই ঘটনায় তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এ বিষয়ে একটি মামলা চলমান, যেখানে তার নাম নেই। মামলাটির তদন্ত চলছে।

এখানেই শেষ নয়। ঈশ্বরগঞ্জ থানায় যোগদানের পর থেকেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটতে শুরু করেছে। চুরি-ছিনতাই, মাদক, জুয়া, কিশোর গ্যাং, অজ্ঞান পার্টি,ইভটিজিং এবং ধর্ষণের মতো অপরাধ বেড়ে যায়। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না এসব অপরাধ। এতে উপজেলার বাসিন্দারা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। আর এসব কিছুর জন্য উপজেলাবাসী দায়ী করছেন থানার ওসি ওবায়দুর রহমানকে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওসি যোগদানের পর থেকে আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেফতার এড়াতে মোটা অংকের টাকা বাণিজ্য করে চলছেন। মাদক, জুয়া, ধর্ষণ ও হত্যা মামলার আসামিদের ধরে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেন অথবা ৩৪ বা ৫১ ধারায় কোর্টে পাঠিয়ে মোটা অংকের টাকা বাণিজ্য করেন তিনি।

আর ওসির এমন ঘুষ বাণিজ্যে নরমাল ধারায় কোর্টে প্রেরণ করার পর থানায় পুলিশ আসার আগেই আসামি বাড়িতে চলে আসে। যে কারণে ওসিকে প্রত্যাহার চান বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাসহ উপজেলার সাধারণ মানুষ।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ মাসে ঈশ্বরগঞ্জ থানায় মোট ৭১টি মামলা হয়েছে। যারমধ্যে ৩টি হত্যা, ৪টি চুরি, নারী নির্যাতন ৯টি, মাদক ১৫টি, পুলিশ লাঞ্চিত ২টি, অন্যান্য ৩৮টি। তারমধ্যে জুয়া আইনে ৪০ জন, পুলিশ আইনে ৩৩ জন, পরোয়ানা মূলে ১০৫ জন এবং অন্যান্য ১০জনসহ মোট ২৬৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এতে গ্রেফতার প্রায় অর্ধেক আসামিদের কাছ থেকে অর্থনৈতিক বাণিজ্য করেছে ওসি।

এসব বাণিজ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো- উপজেলার জাটিয়া উচ্চ বিদ‍্যালয়ের নৈশপ্রহরী আরমান হোসেন (২৪) হত্যা মামলার আসামিদের না ধরে সাধারণ মানুষদের হত্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করেছে পুলিশ। চারজনকে আটকের পর ৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে থানা থেকে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।

এদিকে উপজেলার রাজিবপুর ইউনিয়নের দুই কিশোরীকে ধর্ষণ ও আঠারবাড়ি পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র থেকে যুবলীগ নেতা মিজানুর রহমানকে ছিনতাইয়ের ঘটনায় মোটা অংকের টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয়ার অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।

অপরদিকে উপজেলা জুড়ে অনলাইন জুয়াড়ি ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। সেই অনলাইন জুয়াড়িদের ধরে এনে মোটা অংকের টাকা নিয়ে থার্টি ফোর ধারায় চালান দিয়ে দিনের ভেতরেই জামিনে আসার সুযোগ করে দেন ওসি।

এমন অসংখ্য অভিযোগে অপরাধীদের গ্রেফতারে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে জনমনে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। থানায় দালালদের দৌরাত্ম্যে সেবাপ্রার্থীরা পড়ছেন বেকায়দায়। ওসির নিয়ন্ত্রণে থাকা দালালদের খপ্পরে থানায় সেবা নিতে আসা মানুষদের গুণতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। এ সকল ঘটনার পর মানুষের জান-মালের নিরপত্তা নিশ্চিতে অনতিবিলম্বে চুরি, ছিনতাই, ধর্ষণ, গ্রেফতার বাণিজ্য বন্ধে পুলিশকে তৎপর হওয়ার আহ্বান জানায় ছাত্র-জনতা।

ঈশ্বরগঞ্জের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির বিষয়ে পৌর বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি এ কে এম হারুন অর রশিদ হারুনের সাথে কথা হলে তিনি জানান, দেশের চলমান পরিস্থিতে আমাদের সবার এখন ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কিন্তু বর্তমান ওসি যেভাবে থানা পরিচালনা করছে এবং যেভাবে গ্রেফতার বাণিজ্য শুরু করছে এতে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। আর এভাবে চলতে থাকলে আইনশৃঙ্খলার আরো অবনতি হবে।

ঈশ্বরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওবায়দুর রহমানের উপজেলার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে বলেন, ‘উপজেলার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। চুরি-ছিনতাইয়ের রহস্য উদঘাটন ও ধর্ষণ মামলার আসামিসহ অপরাধীদের গ্রেফতারে থানা-পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে।’